চাকরি রীনার ভালো লাগছে। সুন্দর ছিমছাম অফিস। ভালো ব্যবসা হচ্ছে। অফিসের লোকজনদের মুখ দেখেই তা বোঝা যায়। সবার ভেতরই ব্যস্ততা। রীনার বসকেও তার পছন্দ হয়েছে। স্মার্ট মানুষ। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। টকটকে লাল গেঞ্জি গায়ে দিয়ে একদিন অফিসে এসেছিলেন। তাকে পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েসী। যুবকের মতো লাগছিল। ভদ্রলোকের কথাবার্তা মার্জিত। অফিসের বসরা সব সময় গোমড়া মুখে থাকেন। ভদ্রলোকের মুখে গোমড়া না–কথায় কথায় রসিকতা করেন। রসিকতা যখন করেন–এমন গভীর ভঙ্গিতে করেন যে প্রথম কিছুক্ষণ বোঝাই যায় না–রসিকতা।
প্রথম দিন রীনা তার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দরজায় পেতলের দুটা অক্ষর A.H. –আজিজুর হকের আদ্যক্ষর। নামের বদলে কেউ শুধু আদ্যক্ষর দরজায় লাগিয়ে রাখতে পারে রীনা ভাবে নি। সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ভদ্রলোক বললেন, রীনা কী খবর?
রীনা বলল, জ্বি স্যার ভালো।
কাজ বুঝে নিয়েছেন?
জ্বি।
আপনার কাজটা কী বলুন তো?
রীনা হকচাকিয়ে গেল। তাকে রিসিপশনে বসতে বলা হয়েছে। এর বেশিকিছু বলা হয় নি। ভদ্রলোককে সেটা বলা কি ঠিক হবে? রীনা ইতস্তত করতে লাগল। হক সাহেব বললেন, ওরা আপনাকে কী করতে বলেছে, আমি জানি না। আপনার প্রধান কাজ হচ্ছে রোজ একবার এসে আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ হাসিমুখে গল্প করা। অফিসের বেশিরভাগ মানুষ গোমড়া মুখে বসে থাকে। আমার অসহ্য লাগে।
রীনা খানিকটা হকচাকিয়ে গেল। ভদ্রলোকের এ জাতীয় কথা বলার মানে কী? মেয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে অফিস বসদের নানান ধরনের গল্প শোনা যায়। এর রকমই কি? উনি কি অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছেন?
রীনা।
জ্বি।
আমার কথা শুনে মোটেই ঘাবড়াবেন না। রসিকতা করছি। তবে আমি সত্যি সতি্যু হাসিমুখ দেখতে পছন্দ করি। নকল হাসিতেও আমার আপত্তি নেই। সত্যি কান্নার চেয়েও নকল হাসি আমার কাছে অনেক ভালো। ঠিকমতো কাজ শিখুন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি–মেয়েরা যখন অফিসে কাজ করতে আসে তখন তারা হয় দারুণ কাজের হয়, নয়তো নিতান্তই অকাজের হয়। মাঝামাঝি কিছু মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না, শুধু পুরুষদের মধ্যেই দেখা যায়। আমি কর্মী মহিলা চাই। গল্পবাজ মহিলা না যাদের প্রধান কাজ ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে লিপষ্টিক বের করে ঠোঁটে ঘষা। প্রথম দিনে অনেক কথা বলে ফেললাম—আর না।
রীনা প্ৰথম কাজ শুরু করেছিল রিসিপশনে–এখন তাকে দেয়া হয়েছে ফরেন করেসপনডেন্স ডেস্কে। যে বুড়ো ভদ্রলোকের কাছে তাকে কাজ শিখতে হচ্ছে তিনি খিটখিটে এবং বদমেজাজি। কথায় কথায় তিনি রীনাকে ধমক দেন। তবে প্ৰায় প্রতিদিনই বলেন–তোমার মাথা পরিষ্কার। অন্যরা যে কাজ এক বছরে শিখেছে তুমি তা শিখেছ এক মাসে।
এই জাতীয় কথা শুনতে আনন্দ লাগে। বুড়ো ভদ্রলোক রীনাকে শুধু যে আনন্দ দেবার জন্যে এই কথাগুলো বলছেন–তা যে না, রীনা নিজেও তা বুঝতে পারে। কাজ করতে তার ভালো লাগে। হক সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে একদিন বললেন, আপনার কাজের খুব সুনাম শুনি। আপনি স্পোকেন ইংরেজি কেমন জানেন?
রীনা বলল, ভালো জানি না স্যার।
ভিসিআরে বেশি বেশি ইংরেজি ছবি দেখে স্পোকেন ইংলিশ বানিয়ে নিন। আপনাকে আমরা আমাদের লন্ডন অফিসে পাঠিয়ে দেব। দেশের বাইরে যেতে আপত্তি নেই তো?
জ্বি না স্যার।
আপনার পারিবারিক আনফরচুনেট অবস্থার কথা আমাকে বলা হয়েছে। পারিবারিক বিধিনিষেধ নেই তো?
জ্বি না।
ভালো করে ভেবে বলুন। সব ঠিকঠাক করে আপনার বাইরে যাবার ব্যবস্থা হলো হলো–তারপর আপনি বেঁকে বসলেন বা আপনার স্বামী বেঁকে বসলেন। এমন হবে না।
জ্বি না।
হুট করে কিছু বলতে হবে না। আপনি সপ্তাহখানিক ভাবুন। তারপর বলুন।
রীনা এক সপ্তাহ ভেবেছে। কখনো তার কাছে মনে হয়েছে–না সম্ভব না। দেশে সে আছে বলেই অন্তত সপ্তাহে একবার সে টগর-পলাশকে দেখতে পারছে। আবার কখনো মনে হয়েছে–সব ছেড়েছুড়ে দূরে চলে যেতে। একবার মনে হলো তারেক যদি শোনে সে লণ্ডন চলে যাচ্ছে তাহলে সে কী বলবে? টেলিফোনে আলাপ করবে না সরাসরি তার অফিসে চলে যাবে? অফিসে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তারেক যদি ভাবে সে আসলে এসেছে ঘরে ফিরে যেতে? ভাবলে ভাবুক। যদি সে সত্যি সত্যি লন্ডনে চলে যায়–যাবার আগে একবার দেখা করাও তো উচিত।
বুধবার দুপুরবেলা রীনা তারেকের অফিসে উপস্থিত হলো। তারেক লাঞ্চ সেরে পান চিবোচ্চিল, রীনাকে দেখে বিস্মিত-অবাক কিছুই হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, রীনা কী খবর?
রীনা বলল, ভালো।
আজ আমার ব্যাডলাক, সকালে এসে দেখ ফ্যান নষ্ট। সকাল থেকে গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। মিস্ত্ৰি আনতে লোক গেছে। এগারটার সময় গেছে–এখন দুটা। মিস্ত্রিও নেই, লোকও নেই। নো ম্যাংগো, নো গানিব্যাগ। আমিও নেই ছালাও নেই।
রীনা বলল, তুমি কেমন আছ?
ভালো।
বাসার খবর কী?
বাসার খবরও ভালো। পলাশ গতকাল রেলিঙের ওপর পড়ে একটা দাঁত ভেঙে ফেলেছে। রক্তটক্ত কিছু বের হয় নি। কট করে দাঁতের একটা কণা ভেঙে গেল।
তোমার চাকরি কেমন চলছে?
ভালো।
প্রথম প্ৰথম চাকরি খুব ভালো লাগে। কিছুদিন পর আর ভালো লাগে না। আমার তো রোজ সকালে অফিসে এসে একবার করে ইচ্ছা করে ফাইল টাইল সব জ্বলিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরি।
কোন দিকে হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে, চিটাগাঙের দিকে?