হাসান। জ্বি স্যার। আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন দেখেছি প্ৰচণ্ড গরমের সময় বুড়ো ধরনের মানুষরা গামছা ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে বসে থাকত। তুমি কি এ রকম দৃশ্য দেখেছ?
জ্বি না স্যার।
গরমের সময় ভিজিয়ে, গায়ে রাখার জন্যে আলাদা গামছাই পাওয়া যেত। মোটা মোটা সুতা–গামছাগুলোকে বলত জলগামছা।
হাসান মনে মনে কয়েকবার বলল, জলগামছা। জলগামছা। জলগামছার ব্যাপারটা লিখে ফেলতে হবে। কোনো এক ফাঁকে এই তথ্য ঢুকিয়ে দিতে হবে। শুধু জলগামছা আওড়ালে মনে নাও থাকতে পারে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা শব্দ বলা দরকার–
জলগামছা
পানিগামছা
ওয়াটারগামছা
হাসান।
জ্বি স্যার। সবচে’ কষ্টের গরম কোন মাসে পড়ে জান?
জ্বি না স্যার।
ভাদ্র মাসে। ভাদ্র মাসের গরমকে বলে তালপাকা গরম। তখন বাতাসে জলীয় বাষ্প খুব বেশি থাকে। গরমটা বেশি লাগে এই কারণে। একবার ভাদ্রমাসে কী হয়েছে শোন–আমি তখন ক্লাস খ্রিতে পড়ি। আমাদের বাসা নেত্রকোনার উঁকিলপাড়ায়। দু কামরার ঘর। সাধারণ নাম হলো হাফ বিল্ডিং। করোগেটেড টিনের ছাদ। টিনের ছাদের বাড়ি রাতে ঠাণ্ডা হবার কথা। আমাদের বাসা কখনোই ঠাণ্ডা হতো না। আমরা সাত ভাইবোন গরমে ছটফট করতাম।
স্যার আপনি একবার বলেছিলেন। আপনারা আট ভাইবোন।
যখনকার কথা বলছি তখন আমরা সাত জন। আমার মেজো ভাই রাগ করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিল। অত্যন্ত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে রাগ করেছিল। তার কেডসের জুতার ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেই ফিতা কিনে দেয়া হচ্ছিল না। একটা জুতায় ফিতা ছিল, আরেকটায় ছিল না। সেই জুতাটা খুলে খুলে আসত। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। বাবা প্রতিদিন বলতেন, আজ ঠিক নিয়ে আসব। আসতেন না। একদিন স্কুল থেকে বাসায় না ফিরে সে বাড়ি চলে গেল, সেদিন বিকেলে বাবা ফিতা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই।
স্যার আপনার ভাইটার নাম কী?
ভাইয়ের গল্প তো এখন করছি না। এখন তোমাকে বলছি অন্য গল্প। মেজো ভাইয়ের গল্প যখন বলব। তখন নাম বলব।
জ্বি আচ্ছা।
আমি কী বলছিলাম যেন?
আপনার সাত ভাইবোন গরমে ছটফট করতেন।
ও হ্যাঁ, আমরা গরমে ছটফট করতাম। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত তালপাখা দিয়ে আমাদের হাওয়া করতেন। সেই পাখা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া হতো। ভেজা পাখার হাওয়া নাকি ঠাণ্ডা।
একদিনের কথা–বাবা বাসায় ফিরলেন অনেক দেরিতে। তার হাতে বাজার করার চটের একটা ব্যাগ, মুখ হাসি হাসি। তিনি রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন–কোথায় আমার সৈন্যসামন্ত। আমরা ছুটে এলাম। বাবা চটের ব্যাগ খুললেন। ব্যাগের ভেতর খবরের কাগজে মোড়া চকচকে নতুন সিলিং ফ্যান। আমরা হতভম্ব! সেই রাতেই ফ্যান লাগানো হলো। বাবা নিজেই মিস্ত্রি। রাবারের জুতা পরে তিনি ইলেকট্রিসিটির কানেকশন দিলেন। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। কী বাতাস, মনে হচ্ছে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তিনি গভীর গলায় বললেন, এখন থেকে এক ঘুমে রাত কাবার করে দিবি। হা করে ঘুমোবি যাতে পেটের ভেতরেও ফ্যানের হাওয়া চলে যায়।
সেই ফ্যান সর্বমোট আমরা তিনদিন ব্যবহার করি। চতুর্থ দিনে বাড়িতে পুলিশ এসে উপস্থিত। আমরা বিস্মিত হয়ে জানলাম বাবা যে দোকোনে কাজ করতেন সেই দোকানের একটা ফ্যান তিনি খুলে নিয়ে চলে এসেছেন।
আমাদের চোখের সামনেই সিলিং থেকে ফ্যান খোলা হলো। বাবা সবার দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণই অমায়িক ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। যেন বেশ মজাদার একটা ঘটনা ঘটেছে। তিনি এই ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করতে পেরে আনন্দিত।
দোকানের মালমাল চুরির অভিযোগে বাবার বিরুদ্ধে মামলা হয়। বাবার দু মাসের জেল হয়ে যায়। কোর্টে আমরা কেউ ছিলাম না। শুধু আমার বড় বোন ছিলেন। মামলার রায় হবার পরে বাবা তাকে বলেন, পুষ্প কোনো রকম চিন্তা করিস না। জেলখানায় বিশ দিনে মাস হয়। দুই মাস আসলে চল্লিশ দিন। চল্লিশটা দিন তুই কোনো রকমে পার করে দে। পারবি না মা?
আমার বড় বোন পুষ্পের কথা কি এর আগে তোমাকে বলেছি?
জ্বি না।
ডাকমান পুষ্প, ভালো নাম লতিফা বানু।
হিশামুদ্দিন সাহেব চুপ করলেন। সামনে রাখা পানের বাটা থেকে পান নিলেন। রুমালে ঠোঁট মুছলেন। আবার মাথা উঁচু করে ফ্যানের দিকে তাকালেন।
হাসান।
জ্বি স্যার।
মানুষের প্রধান সমস্যা হলো সে কোনো কিছুই খুঁটিয়ে দেখে না। তার সব দেখা, সব observation ভাসা ভাসা। ঠিক না?
হাসান চুপ করে রইল। মানুষের প্রধান সমস্যা কী তা নিয়ে সে কখনো ভাবে নি। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন কেন তাও তার কাছে পরিষ্কার না। তবে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই স্বভাব আছে। কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। তারপর আবার মূল বক্তব্যে ফিরে আসেন।
হিশামুদ্দিন বললেন, তুমি এক শ টাকার নোট অনেকবার দেখেছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তুমি বলতে পারবে না এক শ টাকার নোটের দু পিঠে কী ছবি আছে। বলতে পারবে?
জ্বি না স্যার।
একপিঠে আছে লালবাগ দুর্গের ছবি, আরেক পিঠে তারা মসজিদের ছবি। তোমার সঙ্গে এক শ টাকার নোট আছে না? আমার কথা মিলিয়ে দেখ।
এক শ টাকার নোট নেই স্যার।
কত টাকার নোট আছে?
দশ টাকার।
দশ টাকার নোটের এক দিকে আছে কাপ্তাই বাঁধের ছবি, আরেকদিকে টাঙ্গাইলের একটা মসজিদের ছবি–আতিয়া জামে মসজিদ। মানিব্যাগ খুলে দেখ।