হিশামুদ্দিন সাহেব পান চিবোচ্ছেন। তার হাতের কাছে ধবধবে সাদা রুমাল। তিনি মাঝে মাঝে রুমালে ঠোঁট মুছছেন। সাদা রুমালে পানের রসের লাল দাগ ভরে যাচ্ছে। হিশামুদিন সাহেবের বয়স কত? হাসান জানে না। ঠিক অনুমানও করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু মানুষের বয়স ধরা যায় না। হাসানের ধারণা হিশামুদ্দিন সাহেবের বয়স চল্লিশও হতে পারে। আবার ষাটের কাছাকাছিও হতে পারে। তবে চল্লিশ হবার সম্ভাবনা কম। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কেউ কোটি কোটি টাকা রোজগার করতে পারে না।
হিশামুদিন ঘরের সিলিঙের দিকে তাকালেন। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ফুল স্পিড়ে ঘুরছে না, ধীরে সুস্থে ঘুরছে। গরম বাতাস গায়ে এসে লাগছে। হিশামুদ্দিন সাহেব প্রথম প্রশ্নটি আবারো করলেন–নিচু গলায় বললেন, হাসান তোমার গরম লাগছে?
হাসান লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।
বলতে গিয়ে কথা খানিকটা আটকেও গেল। যেন গরম লাগাটা ঠিক না। যেন সে একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
হিশামুদ্দিন বললেন, আজকের টেম্পারেচার কিন্তু গতকালের চেয়ে কম। গতকাল ছিল থাটি ফাইভ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আজ থাটি ফোর। এক ডিগ্রি কম। তারপরেও গরম বেশি লাগছে। কারণটা হিউমিডিটি। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে গরম বেশি। লাগে। আজ বাতাসে জলীয় বাম্পের পরিমাণ বেশি। এর মানে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। আমার ধারণা রাত নটা-দশটার দিকে বৃষ্টি শুরু হবে।
হাসান চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। তার কাজই হচ্ছে কথা শুনে যাওয়া। আলোচনায় অংশগ্ৰহণ না করা। কথা শোনার জন্যে সে টাকা পায়। ঘণ্টা হিসেবে রেট। প্রতি ঘণ্টায় ছয় শ’ টাকা। শুরুতে হাসানের মনে হয়েছিল অনেক টাকা। এখন সে জানে টাকাটা আসলে খুবই কম। হিশামুদ্দিন সাহেব কখনোই তাকে বিশ-পঁচিশ মিনিটের বেশি সময় দেন না। এত সময় তার কোথায়? বিশ-পাঁচিশ মিনিটে যা বলেন হাসানকে তা মন দিয়ে শুনতে হয়। তার দায়িত্ব শোনা কথাগুলো গুছিয়ে লেখা। যেন কোনো ভুলভ্রান্তি না হয়। হাসানের ধারণা এই কাজটা একটা টেপরেকর্ডারে খুব ভালো করা যায়। হিশামুদ্দিন সাহেব যা বলার বলবেন। টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করা থাকবে। কথাবার্তা শেষ হবার পর সে ক্যাসেট বাসায় নিয়ে যাবে। ক্যাসেট শুনে শুনে লিখে ফেলবে। কোনোরকম ভুলভ্রান্তি হবে না। হাসান ভয়ে ভয়ে হিশামুদ্দিন সাহেবকে টেপরেকর্ডারে কথাটা বলেছিল। তিনি মন দিয়ে তার কথা শুনেছেন। ভদ্রলোকের এই ব্যাপারটা আছে। কেউ যখন কথা বলে তিনি খুব মন দিয়ে শোনেন। এমনও হয় যে চোখের পলক ফেলেন না। যে কথা বলে সে পলকহীন চোখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভড়কে যায়।
হাসানের কথা শেষ হওয়ার মাত্র হিশামুদ্দিন সাহেব বললেন, যন্ত্রের সঙ্গে কি কথা বলা যায় হাসান? আমি যখন কথা বলি তোমার সঙ্গে কথা বলি, একটা মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তাই না?
জ্বি স্যার।
শোনা কথা লিখতে তোমার ভুলভ্রান্তি হচ্ছে হোক না, পরে ঠিক করা যাবে। ঠিক না করলেও অসুবিধা নেই। আমি তো আমার জীবনী লিখে বই করে ছাপাচ্ছি না। আমি আমার ইন্টারেষ্টিং জীবনীটা লিখতে চাচ্ছি। আমার নিজের জন্যে। যখন কাজকর্ম করার ক্ষমতা থাকবে না-বিছানায় শুয়ে শুয়ে, কিংবা হুইল চেয়ারে বসে বসে পড়ব।
জ্বি স্যার।
তুমি যাতে তালগোল পাকিয়ে না ফেল এই জন্যেই আমি অল্প অল্প করে বলি।
হাসান মনে মনে বলছে-স্যার, আপনি যদি একসঙ্গে অনেকখানি করে বলতেন তাহলে আমার কিছু লাভ হতো। দুটা টাকা বেশি পেতাম।
হিশামুদ্দিন সপ্তাহে একদিন হাসানের সঙ্গে বসেন। বুধবার দুপুর দুটা থেকে তিনটা। এক ঘণ্টা কখনো কথা বলেন না। পনের-বিশ মিনিট পার হবার পরই বলেন–‘আজ এই পর্যন্তই।’ হাসান ঘর থেকে বের হয়ে নিচে আসে। হিশামুদিন সাহেবের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রহমতউল্লাহ দাঁত বের করে বলে, কী, কাজ শেষ?
জ্বি।
পাঁচিশ মিনিট পার হয়েছে। যাই হোক তিরিশ করে দিচ্ছি। রাউন্ড ফিগার। পেমেন্ট নিয়ে যান।
থাক জমুক। পরে একসঙ্গে নেব।
ওরে সর্বনাশ, তা হবে না। স্যারের নির্দেশ আছে সব পেমেন্ট আপটুডেট থাকবে। আসুন ভাই খাতায় সই করে টাকা নিন।
হাসানকে শুকনো মুখে খাতায় সই করে টাকা নিতে হয়। মাঝে মাঝে ভাবে বলবেআমাকে চাকরি দেবার সময় বলা হয়েছিল বুধবারে এক ঘণ্টা করে সিটিং হবে। এক ঘণ্টা হিসেবে আমাকে টাকা দিতে হবে। পাঁচ মিনিট কথা বললেও এক ঘণ্টার পেমেন্ট বলা হয় নি। হাসানের ধারণা কথাটা বলামাত্রই তা বড় সাহেবের কানে চলে যাবে। তিনি বিরক্ত হয়ে ভাববেন–ছেলেটা তো লোভী! হাসান চাচ্ছে না হিশামুদিন সাহেব তাকে লোভী ভাবুন। কারণ প্রথমত সে লোভী না, দ্বিতীয়ত এই মানুষটাকে সে পছন্দ করে।
হাসান।
জ্বি স্যার।
আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ থাক।
জ্বি আচ্ছা! হাসান মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আজ কোনো কথাই হয় নি। তার হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়ি থাকলে বলে দিতে পারত দশ মিনিটের বেশি সময় পার হয় নি। মাত্র এক শ টাকা। হাসান উঠে দাঁড়াতে গোল-হিশামুদিন বললেন, বোস একটু। হাসান বসল। হিশামুদ্দিন রুমাল দিয়ে আবার ঠোঁট মুছলেন। মাথার ওপরের ফ্যানটার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের তাকানোর ভঙ্গি এমন যেন তিনি ফ্যানের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। তার চোখে পলক পড়ছে না।