ও আচ্ছা।
রান্নাও হয়েছে ভালো। এমন খাওয়া খেয়েছি যে হাঁসফাস লাগছে। লবণ দিয়ে লেবুর শরবত করে দাও তো। পানিটা কুসুম কুসুম গরম করে নিও।
রীনা রাতে কিছু খেল না। একা একা খেতে ইচ্ছা করে না। বিয়ের দিন উপলক্ষে সে খুব আগ্রহ করে পোলাও রান্না করেছিল। আশ্চৰ্য, সেই পোলাও কেউ খেল না। লায়লা পোলাও খায় না। হাসানের শরীর খারাপ, সে না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। রীনার শ্বশুর। গিয়েছেন কল্যাণপুর তাঁর মেয়ের বাসায়। রীনার কান্না পাচ্ছে। এত তুচ্ছ ব্যাপারে কাদা ঠিক না। রীনার সমস্যা হচ্ছে বড় বড় দুঃখের ব্যাপারে তার কান্না পায় না। ছোট ছোট ব্যাপারে চোখে পানি চলে আসে।
রীনা ঘুমোতে যাবার আগে হাসানের ঘরে উঁকি দিল। হাসানের ঘরের দরজা খোলা-ঘর অন্ধকার। হাসানের এই অভ্যাস–মাঝে মাঝে দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
হাসান।
জ্বি ভাবি।
দরজা খোলা রেখে ঘুমোচ্ছ। দরজা লাগাও।
ঘুমোচ্ছি না ভাবি। জেগে আছি।
শরীরের অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো। এখন একটু যেন ক্ষিধে ক্ষিধে লাগছে।
কিছু খাবে? পোলাও আছে, গরম করে দেব?
পাগল হয়েছ! দরজার বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছি কেন ভাবি, ভেতরে এস।
রীনা ঘরে ঢুকল। হাসান টেবিল ল্যাম্প জ্বালাল। রীনা খাটের পাশে বসতে বসতে বলল, তুমি ভালো একজন ডাক্তার দেখাও হাসান। দুদিন পরপর তুমি অসুখ বাঁধাচ্ছ।
হাসান দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসেছে। অন্ধকারে খালি গায়ে শুয়েছিলভাবিকে দেখে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে, সেই পাঞ্জাবি উল্টো হয়েছে। বুক চলে গেছে পেছনে। হাসান বিব্রত ভঙ্গিতে পাঞ্জাবি দেখতে দেখতে বলল, ভাবি আমার অসুখটা হলো মনে। মনটা ঠিক নেই, এই জন্যেই শরীর ঠিক থাকছে না।
মন ঠিক নেই কেন?
চাকরি টাকরি পাচ্ছি না–এই জন্যেই মন ঠিক নেই।
তুমি না বললে হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে একটা কাজ করছি।
ওইটা কোনো কাজ না ভাবি। সপ্তাহে একদিন যাই, ভদ্রলোকের কথা শুনি। খাতায় নোট করি। ওই প্রসঙ্গ থাক। আচ্ছা ভাবি হাঁস স্বপ্নে দেখলে কী হয়? ইদানীং খুব হাঁস স্বপ্নে দেখছি। ঘুমোলেই দেখি এক ঝাক হাঁসের সঙ্গে হাঁটছি, সাঁতার কাটছি।
রীনা তাকিয়ে আছে। তার খুব মায়া লাগছে। হাসানকে অসহায় দেখাচ্ছে। রীনার যদি চেনাজানা কোনো মন্ত্রী থাকত। তাহলে সে হাসানের চাকরির জন্যে মন্ত্রী সাহেবের পা ধরে বসে থাকত।
ভাবি যাও ঘুমোতে যাও।
রীনা উঠে দাঁড়াল। হাসান বলল, ভাবি এক সেকেন্ড। তোমার জন্যে সামান্য কিছু উপহার এনেছিলাম। টেবিলের ওপর রেখেছি, নিয়ে যাও। আমি গরিব মানুষ–এরচে’ বেশি কিছু দেবার আমার ক্ষমতা নেই।
রীনা বিস্মিত হয়ে দেখল টেবিলে গোলাপ ফুলের সুন্দর একটা তোড়া। তোড়ায় নাটা গোলাপ। তাদের বিয়ের ন’ বছর আজ পূর্ণ হয়েছে। হাসান বলল, হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভারসারি ভাবি।
রীনা বলল, থ্যাংক য়ু।
তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। গোলাপগুলো এত সুন্দরা মনে হচ্ছে, এইমাত্র বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা হয়েছে।
হাসানের ঘুম আসছে না। সে এপাশ ওপাশ করছে। কাল বুধবার। হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনাকে কি মুখ ফুটে সে বলে ফেলবে–স্যার, আমি খুব কষ্টে আছি। আমাকে পার্মানেন্ট একটা চাকরি দিন। আপনার কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না।
হিশামুদিন সাহেবের কথা ভাবতে ভালো লাগছে না। ঘুমোবার আগে সুন্দর কিছু ভাবা দরকার। তিতলীর কথা ভাবা যায়। তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কাল্পনিক কথাবার্তাও বলা যায়।
তিতলী কেমন আছ?
ভালো আছি।
আজ কী গরম পড়েছে দেখেছি?
হুঁ।
তুমি কি জান আমি যে ঘরে ঘুমোই সে ঘরে কোনো ফ্যান নেই।
জানি না, আমি তো তোমার ঘরে কখনো ঢুকি নি।
আমি করি কী জান? ঘরের দরজা-জানালা সব খুলে ঘুমোই। রীনা ভাবি খুব রাগ করে। রীনা ভাবির ধারণা, দরজা খোলা থাকলেই চোর ঢোকে। চোর ঢুকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমার ঘরে এমন কিছু নেই যে চোর এসে নিয়ে যাবে।
অন্য কিছু নিয়ে কথা বল তো। চোর নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
হাঁস নিয়ে কথা বলি? শোন তিতলী, হাঁস স্বপ্নে দেখলে কী হয় তুমি জান? ইদানীং আমি ঘুমোলেই শুধু হাঁস স্বপ্নে দেখছি
কী হাঁস—রাজহাঁস?
আরে না। আমি ছোট মানুষ, আমার স্বপ্নগুলোও ছোট ছোট–আমি স্বপ্নে দেখি পুড়ি একটা দুটা না-হাজার হাজার পাতিহাঁস। আমার ধারণা, আমি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছি।
তিতলী হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। হাসান কল্পনায় একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার হাসি এত জীবন্ত! হাসান তিতলীর হাসি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। আশ্চর্য তো!
গরম লাগছে
গরম লাগছে?
হাসান বলতে যাচ্ছিল, জ্বি না। স্যার। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। গরম লাগছে। না বললে বোকার মতো কথা বলা হবে। বোকার মতো কথা সে প্রায়ই বলে কিন্তু এই লোকের সঙ্গে বোকার মতো কথা বলা যাবে না। যা বলার ভেবেচিন্তে বলতে হবে। গরমে সে অস্থির বোধ করছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঁঠালপাকা গরম। হাসান যদি কাঁঠাল হতো এর অর্ধেক গরমে পেকে যেত। এখন ভরদুপুর। জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে মাটির তল থেকে গরম ভাপ বের হয়। সেই ভাপে পচা ঘাসের গন্ধ থাকে। হাসান গন্ধ পাচ্ছে।
সে বসেছে মাঝারি সাইজের একটা ঘরে। ঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য বিরাট জানালা। জানালায় ভারি পর্যাদা টানা বলে ঘর আবছা অন্ধকার। মেঝেতে কাপেট বিছানো। কার্পেটের ওপর শীতল পাটি। হাসানের ঠিক সামনেই বসেছেন হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের হিশামুদিন সাহেব। গরম তাঁকে মনে হয় তেমন কাবু করতে পারছে না। তিনি বেশ আয়েশ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছেন। খালি গা। পরনে লুঙ্গি। হাসান লক্ষ করছে লুঙ্গির গিট খুলে গেছে। হিশামুদ্দিন সাহেব ব্যাপারটা জানেন কিনা কে জানে! হয়তো জানেন না। যদি না জানেন তাহলে যে-কোনো সময় একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কথাবার্তা শেষ করে হিশামুদিন সাহেব দাঁড়ালেন এবং লুঙ্গি পা বেয়ে নেমে এল। সর্বনাশ!