স্যার যাইবেন কই?
হাসান কিছু বলল না। রিকশায় উঠলেই তার মানসিকতা একটু যেন বদলে যায়। নির্দিষ্ট কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। রিকশাওয়ালা তার ইচ্ছেমতো নানা জায়গায় নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে রিকশা থামিয়ে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে চা খাবে। আনন্দময় মন্থর ভ্ৰমণ। স্কুলে রচনা আসে–এ জানি বাই ট্রেন, এ জানি বাই বোট। জানি বাই রিকশা রচনাটা আসে না কেন?
স্যার যাইবেন কই?
হাসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল–চলতে থাক। রিকশাওয়ালা হাসল। তবে কথা বাড়াল না। সে ধীরে সুস্থে প্যাডেল চাপছে। হাসান হুড ধরে চুপচাপ বসে আছে। তার মাথা খানিকটা টালমাটাল করছে। বমি করার পর মুখ ধোয়া হয় নি। সমস্ত শরীরই কেমন অশুচি অশুচি লাগছে। কোনো একটা ফোয়ারার পাশে রিকশা থামিয়ে ফোয়ারার পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। ফোয়ারাগুলো নাকি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বানানো হয়েছে। শহরের সৌন্দর্যবর্ধন করা হচ্ছে। হাসান আকাশের দিকে তাকাল। মেঘে মেঘে আকাশ কালো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন মনে আসছে–মেঘের পরে মেঘ জিমেছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কখনো রিকশায় চড়েছেন? মনে হয় চড়েন নি। রিকশায় চড়লে সুন্দর একটা বৰ্ণনা পাওয়া যেত। হাসানের পেট আবার পাক দিচ্ছে। আবারো কি বমি হবে? ঝুম বৃষ্টি নামলে খুব ভালো হতো। বৃষ্টিতে নেয়ে ফেলা যেত। কদিন ধরেই রোজ বিকেলে মেঘ করছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না।
রীনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সকালবেলার নতুন শাড়িটা তার গায়ে নেই। সে পুরনো একটা শাড়ি পরেছে। বেগুনি এবং গোলাপির মাঝামাঝি রং।। নতুন অবস্থায় শাড়িটা পরলে নিজেকে খুব চকচকে লাগত। পুরনো হয়ে শাড়িটা সুন্দর হয়েছে। এই শাড়ি পরে রীনা দাঁড়িয়ে আছে, কারণ একদিন তারেক বলেছিল–বাহ্! শাড়িটায় তো তোমাকে খুব মানিয়েছে। রানার ধারণা তারেকের এটা কথার কথা। হঠাৎ কী মনে হয়েছে—বলেছে। শাড়ির দিকে ভালোমতো না তাকিয়েই বলেছে। স্বামীরা স্ত্রীদের খুশি করার জন্যে মাঝে মাঝে এ ধরনের কথা বলে। যে শাড়িটা পরার জন্যে স্বামী খুব সুন্দর বলে সেই শাড়ি পরে ঘুরলে স্বামী ফিরেও তাকায় না।
রাত দশটার মতো বাজে। তারেকের জন্যে অপেক্ষা। অফিস থেকে বিকেলে বাসায় ফিরেছে। এক কাপ চা খেয়ে হাসিমুখে বলেছে–রীনা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, আধঘণ্টার মধ্যে ফিরব। রীনা বলেছে, যাচ্ছে কোথায়? তারেক জবাব দেয় নি। মুখ টিপে হোসেছে। রীনা ধরেই নিয়েছে–তারেকের শেষ মুহুর্তে বিয়ের দিনের কথাটা মনে পড়েছে। সে যাচ্ছে কিছু একটা কিনতে। পাঁচ-ছটা সস্তার মরা মরা গোলাপ কিনবে। বেলিফুলের মালা ভেবে যে মালাটা কিনবে সেটা আসলে রজনীগন্ধা ফুলের মালা। যা ইচ্ছা কিনুক–বিয়ের দিনের কথাটা মনে পড়েছে এই যথেষ্ট।
এখন মনে হচ্ছে তারেক উপহার। কিনতে যায় নি। কোনো কলিগের বাসায় গিয়েছে। বিয়ের দিনের কথাটা তার মনেও নেই। আসলে বিয়ের দিনটাকে মেয়েরা যত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ছেলেরা হয়তো ততটা করে না। ঘরে সে আজ পোলাও রান্না করেছে। বাচ্চা দুটার এত শখের পোলাও! ওরা না খেয়েই ঘুমিয়েছে। ব্যাপারটা ঘটেছে রীনার জন্যে। ওরা খেতে চেয়েছে–রীনা বলেছে, বাবা আসুক তারপর খাবে। বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বেচারারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এদের ঘুম অসম্ভব গাঢ়। একবার ঘুমেলে। আর জাগবে না। তারেকও নিশ্চয়ই খেয়ে আসবে। বিয়ের দিনে যে পোলাও রান্না হয়েছে সেটা কেউ খাবে না।
ভাবি, অন্ধকারে দাড়িয়ে আছ কেন?
রীনা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। লায়লা চুপিচুপি কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়ে কোনো রকম শব্দ না করে হাঁটতে পারে।
লায়লা বলল, ভাইয়ার জন্যে অপেক্ষা করছ?
না। গরম লাগছিল, তাই বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। কী অসহ্য গরম পড়েছে দেখেছ?
আজ এত মেঘ করেছিল! ভাবলাম— বৃষ্টি হবে, বৃষ্টিতে ভিজব।
খবরদার ভাবি বৃষ্টিতে ভিজবে না, চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে।
চামড়া নষ্ট হবে কেন?
শহরের বৃষ্টি মানেই হলো এসিড রেইন। গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া বৃষ্টির সঙ্গে গায়ে এসে পড়ে চামড়ার বারোটা বাজিয়ে দেবে।
রীনা হাসল। তার এই ননদ শরীরের চামড়া, মাথার চুল, চোখ এইসব ব্যাপারে খুব সাবধান। শরীর ঠিক রাখার নানা কায়দা-কানুন সে করে।
ভাবি, চামড়ার সবচে’ ক্ষতি কীসে হয় তুমি জান?
না।
সবচে’ ক্ষতি করে আলট্রা ভায়োলেট রে। সূর্যের আলোয় যে মেয়ে সবচে’ কম আসবে তার চামড়া থাকবে সবচে’ সুন্দর।
তারেক আসছে। হেঁটে হেঁটে আসছে। মুখে পান। পানের পিক ফেলল-তার মানে খেয়ে এসেছে। লায়লা বলল, ভাবি ভাইয়া চলে এসছে।
তাই তো দেখছি।
তুমি ভাইয়াকে বলে আমার জন্যে দুশ টাকা নিয়ে রেখো তো ভাবি। আমাদের ক্লাসে পিকনিক হচ্ছে–দুশ টাকা করে চাদা। ছেলেরা এক শ আর মেয়েরা দু শি। মেয়েদের হাতে নাকি টাকা বেশি থাকে এই জন্যে চাঁদা বেশি। টাকাটা কাল সকালেই দিতে হবে ভাবি।
আচ্ছা আমি টাকা নিয়ে রাখব।
তারেক হাতমুখ ধুয়ে সরাসরি শোয়ার ঘরে চলে এল। রীনা বলল, ভাত খাবে না?
তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, না।
খেয়ে এসেছ?
হুঁ। আমাদের এক কলিগের মেয়ের আকিকা ছিল। খাসির রেজালা ফেজালা করে হুলস্থূল করেছে।