হাসান বের হয়ে এল। আম্বিয়া খাতুন তখনো হাসছেন। মহিলার কি মাথা আউলা হয়ে গেছে? দাঁত নেই মানুষের হাসিতে অশরীরী ভাব থাকে। গা ছমছম করে। হাসানের গা ছমছম করছে।
সেকান্দর আলি বললেন, চলে যাচ্ছে নাকি?
হাসান বলল, জ্বি না।
মা’র সঙ্গে দেখা তো হয়েছে। শুধু শুধু বসে থেকে কী করবে, চলে যাও।
দাদিমা খেয়ে যেতে বললেন। মোটা চালের খিচুড়ি খেতে বললেন।
ও আচ্ছা, তাহলে খেয়ে যাও। দেরি হবে কিন্তু। এখন ফকির মিসকিনদের খাওয়াবে। রান্না হয় নি। এখানো। রান্না হবে তার পর। ফকির ব্যাচ শেষ হলে আমাদের খাওয়া। তিনটা বেজে যাবে। থাকবে এতক্ষণ?
জ্বি।
বেশ থাক। এখন করছ কী?
কিছু করছি না।
রহমান যে বলল হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে কী কাজ করছি।
তেমন কিছু না। যা করছি তাকে চাকরি বলা যায় না।
কোনো কাজকেই ছোট করে দেখবে না হাসান। কোনো কাজই ছোট না। শিক্ষিত ছেলেপুলেদের এই এক সমস্যা হয়েছে। চাকরির জাতিভেদ করে ফেলেছে। কাজ হচ্ছে কাজ।
জ্বি।
তিনটা পৰ্যন্ত চুপচাপ বসে না থেকে তুমি বরং ঘুরে টুরে এসো। দুটা-আড়াইটা নাগাদ চলে এসো। অসুস্থ মানুষের বাড়িতে বসে থাকাও তো যন্ত্রণা।
আমার কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না।
সেকান্দর সাহেব বললেন, তাহলে থাক। লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে বোস। বইটিই পড়। লাইব্রেরি ঘরটা নতুন করেছি। কনকর্ডকে দিয়ে ডিজাইন করানো। চার লাখ টাকা নিয়েছে লাইব্রেরি করতে। অল বার্মাটিক। ‘এখন তো আর বই পড়া হয় না। শেষ বয়সে পড়ব এই জন্যে লাইব্রেরি বানানো। যাও দেখা গিয়ে–শেলফ থেকে বই যদি নামাও তাহলে যেখানকার বই সেখানে তুলে রাখবে।
জ্বি আচ্ছা।
চার লাখ টাকা দামের বামটিকের লাইব্রেরি দেখার ব্যাপারে হাসানের উৎসাহ দেখা গেল না। সে লাইব্রেরি ঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইল। সামনে খবরের কাগজ আছে কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছে না। বেকার মানুষ খবরের কাগজ পড়তে পারে না–এই তথ্যটা কি কেউ জানে? মনে হয় জানে না। নতুন বেকাররা অবশ্যি পত্রিকা হাতে নেয়, আগ্ৰহ নিয়ে কর্মখালি বিজ্ঞাপন পড়ে। পুরনো বেকাররা তাও করে না! সে পুরনো বেকার।
খবরের কাগজে মজা কিছু কি আছে? বাণী চিরন্তনী, কিংবা শব্দ জট, এস ওয়ার্ড পাজল?
চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে এই সবের ওপর চোখ বোলানো যায়। শব্দজট পাওয়া গেল। শব্দগুলো উলটাপালট করে লেখা–মূল শব্দ খুঁজে বের করতে হবে। হাসান অনাগ্ৰহ নিয়ে শব্দগুলো দেখছে–
কুলাশান্ত
ণত্রারিপ
জ্ঞভিতাঅ
শেষের দুটা পারা গেলা–পরিত্রাণ এবং অভিজ্ঞতা। প্রথমটা কী? ধাঁধা-শব্দজট এই ব্যাপারগুলো ভয়াবহ, একবার মাথায় ঢুকে গেলে আর বেরোতে চায় না। মাথায় ঘুরতে থাকে। খুবই অস্বস্তি লাগে। হাসানের মাথায় ঘুরছে কুলাশান্ত কুলাশান্ত, কুলাশান্ত, কুলাশন্ত। আসল শব্দটা কী? পারমুটেশন কম্বিনেশনে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না–
লাশন্তকু
কুশলান্ত
স্তশলাকু
কিছুই তো হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে হাসানের মাথা ধরে গেল। সে মাথা ধরা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আশ্চর্য কাণ্ড ঘুমের মধ্যে আবারো সেই উদ্ভট স্বপ্ন!! সেই হাঁসের দলের সঙ্গে সে। এবারের হাঁসগুলো মানুষের মতো কথা বলছে। সদিবসা গলায় খ্যাস খ্যাস করে কথা। হাসান তার পাশের হাঁসটিকেজিজ্ঞেস করল-তুমি শব্দজট ছাড়াতে পার?
হাঁসটা বলল, জ্বি স্যার পারি।
‘কুলাশান্ত জট ছাড়ালে কী হবে?
এটা পারব না। এটা পারব না।
তোমাদের মধ্যে কেউ পারবে না?
জ্বি না। তবে একজন পারতে পারে–তার খুব বুদ্ধি।
সে কে? তার নাম শকুন্তলা।
হাঁসের নাম শকুন্তলা।
জ্বি। আপনাদের যেমন নাম আছে–আমাদেরও আছে। ওই যে শকুন্তলা, ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন।
জিজ্ঞেস করতে হবে না। শব্দ জট দূর হয়েছে। কুশলান্ত হলো শকুন্তলা।
হাসানের ঘুম ভাঙল। আশ্চর্য! বেলা পড়ে এসেছে। ঘড়িতে বাজছে চারটা দশ। এত লম্বা ঘুম সে দিল কীভাবে? সে কি অসুস্থ? অসুস্থ মানুষরাই সময়ে-অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে উদ্ভট এবং জটিল স্বপ্ন দেখে।
বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ফকির মিসকিনরা কি খিচুড়ি খেয়ে চলে গেছে? তাকে কেউ ডাকে নি। রেডক্রস আঁকা একটা গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আম্বিয়া খাতুনকে দেখতে কোনো ডাক্তার বোধহয় এসেছেন। হাসানের পেট চক্কর দিয়ে উঠছে। সে রাস্তার পাশে বসে হাড় হড়া করে বমি করল।
শরীরটা আসলেই খারাপ করেছে। মাথা টলমল করছে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কী হবে বাসায় ফিরে?
স্যার আপনের কী হইছে?
খালি একটা রিকশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। প্রশ্নটা করছে রিকশাওয়ালা। তার গলায় কৌতুহলের চেয়েও মমতা বেশি। একজন মানুষ তার সমগ্র জীবনে একশ’ বার সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে মমতা ও করুণায় আৰ্দ্ধ কথা শুনবে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত। এই রিকশাওয়ালা কি সেই একশ’ জনের এক জন?
স্যার আপনার কী হইছে?
কিছু না। হঠাৎ শরীরটা খারাপ করেছে।
বাড়িত যান। বাড়িত গিয়া ঘুমান। আহেন রিকশাত উঠেন, লইয়া যাই।
রিকশা করে যাবার ভাড়া নেই রে ভাই।
ভাড়া লাগব না, আহেন।
হাসানের কাছে রিকশা ভাড়া আছে। রিকশাওয়ালা সেই একশ জনের এক জন কি না তা পরীক্ষা করার জন্যেই কথাগুলো বলা। মনে হচ্ছে এই রিকশাওয়ালা সেই এক শ জনের এক জন।