রহমানের দাদি আম্বিয়া খাতুনের বয়স প্রায় নব্বই। গত পাঁচ বছর প্যারালিসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। চোখে দেখেন না, তবে কান এবং নাক অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। আম্বিয়া খাতুন হাসানকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কেন করেন। সেই কারণ খুব স্পষ্ট না। হাসান নিজেও কারণ খুঁজতে যায় নি। স্নেহমমতার পেছনে কারণ খুঁজতে যাওয়ার মধ্যে ছোটলোকামি আছে। হাসান দুর্বল মনের মানুষ হলেও ছোটলোক না।
রহমানের বাবা সেকান্দর আলি পুলিশের সাবইন্সপেক্টর ছিলেন। ঘুস খাবার অপরাধে তাঁর চাকরি চলে যায়। তিনি ব্যবসা শুরু করেন এবং দেখতে দেখতে ফুলে ফোঁপে একাকার হয়ে যান। উত্তরায় দশ কাঠা প্লটে তিনি যে বাড়ি করেছেন তা দেখলে পুলিশের সব সাবইন্সপেক্টরই ভাববে–ঘুস খাবার অপরাধে কেন আমাদের চাকরি যাচ্ছে না।
টাকা-পয়সার সঙ্গে মানুষের রুচি এবং মানসিকতা বদলায়। সেকান্দর আলি সাহেবের পরিবারের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি ঘটেনি। তারা আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড বাড়ির সদস্যরা যদি নাভিতে সরিষার তেল দিয়ে রোদে শুয়ে থাকে তাহলে কেমন যেন মানায় না। সেকান্দর আলী সাহেবের পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকালে মনে হয় তারা সবাই যেন নীরবে বলছে-দূর ভালো লাগে না, আগে যখন গরিব ছিলাম। তখনই ভালো ছিলাম।
হাসান রহমানদের রাজপ্রাসাদে পৌঁছাে সকাল এগারটায়। পোজপাজ আগে যা ছিল তার চেয়েও বেড়েছে। পোশাক পরা দুই দারোয়ান— একজনের হাতে ব্যাটন।
রহমান বাসায় ছিল না। সেটা কোনো সমস্যা না। হাসানকে এ বাড়ির সবাই চেনে। সে যে আজ আসবে, এটাও সবাই জানে। সেকান্দর আলি সাহেব বিরক্ত মুখে বারান্দার সোফায় বসে আছেন। তাঁর খালি গা। বিশাল ভূঁড়ি ওঠানামা করছে। সকালবেলা দেখার মতো কোনো সুন্দর দৃশ্য না। সেকান্দর আলি সাহেব তাকে দেখে বললেন, যাও দেখা দিয়ে আসা। তোমার জন্যে দম আটকে আছে কি না কে জানে; পরশু থেকে তোমার কথা বলছে। আধাপাগল তো, একবার মাথায় কিছু ঢুকে গেলে আর বের হয় না।
এখন অবস্থা কী?
অবস্থা আর কী, অক্সিজেন চলছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। কাল রাত তিনটায় শ্বাস উঠল— আমি ভাবলাম ঘটনা বুঝি ঘটেই যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে আনালাম। ভোরবেলা আবার দেখি সামলে উঠেছেন। দুঃখ-কষ্টে মানুষ হয়েছেন তো, শক্ত শরীর।
হাসান কিছু বলল না। সেকান্দর আলি বিরক্ত গলায় বললেন, গত তিন দিন ধরে কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘরে বসে আছি। কোনো একটা কাজে যাব–মারি দম বের হয়ে যাবে। শেষ সময়ে দেখা হবে না। ঠিক বললাম না?
জ্বি ঠিক বলেছেন।
তুমি যাও দেখা করে আস।
উনার জ্ঞান আছে তো?
জ্ঞান আছে মানে? টনটনা জ্ঞান। এখনো তার সাথে তুমি কথায় পারবে না। তুমি একটা কথা বললে তোমাকে দশটা কথা শুনিয়ে দেবে।
আম্বিয়া খাতুন বোধহয় ঘুমোচ্ছিলেন। সাধারণত তাঁর ঘরে পা দেয়ামাত্র তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কে? আজ একেবারে বিছানার পাশে এসে দাড়াবার পর বললেন, কে?
হাসান বলল, দাদিমা আমি হাসান।
তোকে খবর দিয়েছে কখন?
কাল সন্ধ্যায়।
এখন বাজে কয়টা?
এগারটা।
কতক্ষণ পর দেখা করতে এলি?
সতের ঘণ্টা পর।
এত দেরি হলো কেন?
দাদিমা আমি খবর পেয়েছি আজ সকালে।
তোর চাকরি বাকরি এখনো কিছু হয় নি?
না।
ব্যবসা পাতি করবি?
না।
না কেন? ব্যবসা কি খারাপ? আমাদের নবীজী কি ব্যবসা করেন নি?
আমি তো তাঁর মতো না দাদিমা। সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষ না। তুই গাধামানুষ।
হতে পারে।
তোর বন্ধুবান্ধব সব চাকরি বাকরি পেয়ে গেল তুই পেলি না। এটা কেমন কথা!
পেয়ে যাব।
কবে পাবি? খবরটা তো শুনেও যেতে পারব না যে তোর চাকরি হয়েছে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বিছানার পাশে বোস-নাকি রোগীর বিছানায় বসতে ঘেন্না লাগে!
হাসান বসল। বৃদ্ধ এক হাতে হাসানের হাত ধরলেন, ক্লান্ত গলায় বললেন, ব্যবসাপাতি যদি করতে চাস, বল, আমি সেকান্দরকে বলব। সেকান্দর আমার কথা ফেলবে না। পাপী ছেলে তো এই জন্যেই ফেলবে না। পাপী ছেলেপুলে বেশি মাতৃভক্ত হয়। তাদের মন থাকে দুর্বল। সব সময় মনে করে–মা মনে কষ্ট পেলে সর্বনাশ হবে। আসলে হয় না কিছুই। আল্লাহপাক কপালে যা লিখে রেখেছেন তাই হয়। মাকে ভক্তি করলেও হয়, মাকে ভক্তি না করলেও হয়। হাসান!
জ্বি।
দুপুরে খেয়ে যাবি। ওরা আজ আমার রোগমুক্তির জন্যে ফকির খাওয়াচ্ছে। খিচুড়ি রান্না হয়েছে। দুই পদের খিচুড়ি হয়েছে –ফকির মিসকিনদের জন্যে ইরি চালের খিচুড়ি, আর ঘরের মানুষের খাবারের জন্যে কালিজিরা চালের খিচুড়ি।
আমি কোন খিচুড়ি খাব?
তুই তো ফকির মিসকিনের মতোই। তুই খাবি ইরি চালের খিচুড়ি। রাগ করলি?
জ্বি না।
আমি সেকান্দরকে ডেকে বললাম, বাবা দুই পদের খিচুড়ি করলি কোন আন্দাজে? গরিব মানুষকে খাওয়াবি-ভালো কিছু খাওয়া। সে বলল, মা চিকন চালের খিচুড়িতে ওদের পেট ভরে না। এই জন্যেই মোটা চাল। আমি তখন বললাম, খুব ভালো বুদ্ধি করেছিস। শোন বাবা, তুই আজ মোটা চালের খিচুড়ি খাবি। এটা আমার আদেশ। এই শোনার পর থেকে সেকান্দর আলি মুখ শুকনা করে বসে আছে। তার কত বড় ভূঁড়ি হয়েছে দেখেছিস। চার-পাঁচ বালতি চর্বি আছে ওই ভুঁড়ির ভেতর। হিহিহি।
আম্বিয়া খাতুন শব্দ করে হাসতে লাগলেন। হাসির দমকে নাক থেকে অক্সিজেনের নলটা ছুটে গেল। নার্স এসে নল লাগিয়ে হাসানকে কঠিন গলায় বলল–রোগীকে শুধু শুধু হাসাবেন না। ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের রোগী। আপনি এখন যান।