রীনা অস্বস্তি নিয়ে পোস্টম্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। না সে তাদের বাড়িতে আসছে না। ওই তো রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। রীনা প্ৰায় এক মাস আগে রেজিস্ট্রি করা একটা চিঠি পেয়েছিল। পত্র প্রেরকের কোনো নাম নেই। আধপৃষ্ঠায় একটি চিঠিতে লেখা–
ম্যাডাম,
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার স্বামীর অফিসে চাকরি করি। একটি বিশেষ কারণে আপনাকে এই পত্ৰ লিখছি। আমাদের অফিসে লাবণী নামে একজন অল্পবয়স্ক টাইপিষ্ট আছেন। আপনার স্বামী তারেক সাহেবের সঙ্গে তার গভীর প্রণয়। তাদের শারীরিক সম্পর্ক আছে ইহা নিশ্চিত। আমি ভেতরের খবর জানি। আপনি ঘর সামলান। বিলম্বে পাস্তাবেন।
ইতি
আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী জনৈক অচেনা বন্ধু
এই চিঠির কথা রীনা কাউকে বলে নি। উড়ো চিঠিকে কখনো গুরুত্ব দিতে নেই। রীনার হিতাকাঙ্ক্ষী অচেনা বন্ধু তাকে নামহীন চিঠি পাঠাবে না। সবচে’ বড় কথা তারেককে সে চেনে। অতি সরল ধরনের একজন মানুষ। একজন সরল মানুষের জীবন যাপনের পদ্ধতিও সরল হয়।
চিঠি পাবার পর রীনা একবার ভাত খেতে খেতে তারেককে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা! তোমাদের অফিসে লাবণী নামের কোনো মেয়ে আছে?
তারেক বিস্মিত হলো না, চমকাল না। রীনার দিকে তাকালও না–ভাত মাখতে মাখতে বলল, আছে। টাইপিস্ট। আমাদের দুজন মহিলা আছেন। ক্যাশ সেকশনে নতুন একটা মেয়েকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। নাম সুস্মিতা।
মেয়েদের সঙ্গে তোমাদের কথা হয় না?
হ্যাঁ হয়। হবে না কেন? সুস্মিতা মেয়েটা পাগলা ধরনের–সারাক্ষণ কথা বলে।
লাবণী কম কথা বলে? ওর কথা বলার সুযোগ কোথায়! বড় সাহেবের চিঠি টাইপ করতে করতে হালুয়া টাইট।
লাবণীদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
জানি না তো কোথায়? আচ্ছা জিজ্ঞেস করে দেখব।
থাক তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না।
লাবণী দেখতে কেমন?
দেখতে ভালো। গোল মুখ। সুস্মিতা দেখতে ভালো না; মিকি মাউসের মতো দুটা বড় বড় দাঁত।
কথা এই পৰ্যন্তই। তারেক না হয়ে অন্য যে কেউ হলে জিজ্ঞেস করত–লাবণীর কথা জানতে চাচ্ছ কেন?
তারেক সেই প্রশ্ন করবে না। একজন সরল মানুষ পৃথিবীর সমস্ত প্রশ্নই সরলভাবে গ্ৰহণ করে।
রীনার মনে কোনো শঙ্কা নেই তারপরেও চিঠিটা কাউকে দেখাতে ইচ্ছা করে। হাসানকে দেখালে কেমন হয়? না, তা সম্ভব না। হাসান তাকে নিয়েই হাসাহসি করবে। অলীক এক গল্পের পেছনে সময় নষ্ট করার বা দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। দুশ্চিন্তার অনেক ব্যাপার। আমাদের চারপাশেই আছে।
বাচ্চাদের আসতে দেখা যাচ্ছে। রীনা দেখল টগর ঘুমোচ্ছে। রীনার শ্বশুর ছেলেকে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরে আছে। তবে জড়িয়ে ধরে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটার পা অনেকখানি বের হয়ে আছে। যে-কোনো সময় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত। একটা ট্রাক কিংবা মাইক্রোবাস এসে ঘষা দিয়ে চলে গেল। ভাগ্যিস হয় নি! কমলার মাকেও আসতে দেখা গেল। ঘুমন্ত টগরকে রীনার শ্বশুর কমলার মার কোলে দেবার চেষ্টা করছেন। কমলার মা অতি সেয়ানা–সে ভুলেও নেবে না। বেচারা বুড়ো মানুষকেই নাতি কোলে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হবে।
রানার শ্বাশুড়ি আছেন কল্যাণপুরে তাঁর মেয়ের বাসায়। স্বামীর সঙ্গে রাগ করে চলে গেছেন। রাগ ভাঙিয়ে তাকেও কল্যাণপুর থেকে আনতে হবে। রীনার শ্বশুর রাগ ভাঙানোর প্রচুর চেষ্টা করছেন–প্রতিদিন একবার করে কল্যাণপুরে যাচ্ছেন। লাভ কিছু হচ্ছে না–রোজ রিকশা ভাড়া দিতে হচ্ছে। টগরের বাবা ফিরলে তাকে দিয়ে মাকে আনিয়ে নিতে হবে। ছেলে গেলে মা সুড়সুড়ি করে চলে আসবেন। এ রকম ছেলেভক্ত মা খুব কম আছে।
টগরের ঘুম ভেঙেছে। দাদার কোল থেকে নেমে সে এখন ছুটতে ছুটতে আসছে। মাথাটা সামনের দিকে বাকী করা। এটা তার মহিষ মহিষ খেলা। মহিষের মতো শিং দিয়ে সে মাকে গুতো দেবে। মহিষের বয়স পাঁচ বছর হলে কী হবে গায়ে জোর আছে। রীনা হাসিমুখে মহিষের ধাক্কা সামলানোর জন্যে রেলিং ধরে দাঁড়াল। তার এত ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আলাদীনের চেরাগ ছাড়াও বেঁচে থাকাটা এমন অসহনীয় নয়।
বাড়িওয়ালাদের কাজের মেয়েটি আসছে। মেয়েটার নাম হালিমা। খুব ভালো নাম। নরম স্বভাব। হাসিখুশি। এ রকম একটা কাজের মেয়ে থাকলে খুব ভালো হতো। রীনা হালিমাকে বলে দিয়েছে দেশে গেলে সে যেন তার মতো একটা মেয়ে নিয়ে আসে।
রীনা বলল, কী খবর হালিমা।
হালিমা হাসিমুখে বলল, আফনের টেলিফোন আইছে গো আফা। জরুরি ফোন।
বাড়িওয়ালার বাসার টেলিফোন নাম্বারে ভাড়াটেদের ফোন এলে তাদের ডাকা হয় না। কোনো দুঃসংবাদের ফোন কি এসেছে? মৃত্যু সংবাদ? রীনার বুক আবারো ধক করে উঠল। আজকের দিনটা তার জন্যে খারাপভাবে শুরু হয়েছে। বারবার শুধু মৃত্যু সংবাদের কথা মনে আসছে। মানুষের মনে যা আসে তাই শেষ পর্যন্ত হয়। রীনার মুখ শুকিয়ে গেল।
হ্যালো।
কে ভাবি? আমি রকিব।
ও আচ্ছা।
ভাইজান কি অফিস থেকে ফিরেছেন?
না। কেন বল তো?
আমি একটা সিরিয়াস বিপদে পড়েছি ভাবি।
কী বিপদ?
সেটা তোমাকে বলতে পারব না। তবে ভালো বিপদ। ভাবি আমি আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
কেন?
আছে, ব্যাপার আছে। স্টুডেন্ট পলিটিক্সের অনেক ঝামেলা আছে। তুমি বুঝবে না। ভাবি আমার কিছু টাকা লাগবে।
কত টাকা?
পাঁচ হাজার টাকা।
এত টাকা আমি পাব কোথায়?