রীনা রান্নাঘরে ঢুকল। গ্যাসের চুলা দুটিই জ্বলছে। চুলায় কিছু নেই। কমলার মা নির্বিকার ভঙ্গিতে সুপারি কাটছে। কমলার মা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পান খায়। পানের খরচ তাকে আলাদা দিতে হয়।
কমলার মা?
জ্বি।
একটা ডিম সিদ্ধ করা তো।
ডিম নাই আফা।
একটাও নেই?
জ্বি না। আমার পানও ফুরাইছি। সকাল থাইক্যা সুপারি চাবাইতাছি। অখন একটা পান না খাইলে দমফুটা লাইগ্যা মিত্যু হবে।
হবার দরকার নেই–যাও পান নিয়ে আসো। দু হালি ডিম আনবে। আজ ডিমের রকারি করবে। ঘরে বেগুন আছে না? বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি। এস টাকা নিয়ে যাও। রাস্তা সাবধানে পার হবে কমলার মা। গ্যাসের চুলা নিভিয়ে দিয়ে যাও–শুধু শুধু জ্বলছে কেন?
রীনার সংসারের টাকা ষ্টিলের আলমারিতে চকলেটের খালি টিনে আলাদা করে থাকে। আজ মাসের ২৫ তারিখ, সেই টিন খালি। রীনা তা জানে তারপরেও টিন খুলল। টিন আসলেই খালি–একটা চকচকে দশ টাকার নোট পড়ে আছে। টাকার বাক্স পুরোপুরি খালি রাখতে নেই বলেই দশ টাকার নোটটা আছে।
আরেকটা চিনের কৌটা আছে তার শোবার ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে। ইমার্জেন্সি ফান্ড। সেটাও খালি। টাকা-পয়সার এই শোচনীয় অবস্থার কথা তারেককে সে দুদিন আগেই বলেছে। তারেক বলেছে ব্যবস্থা করছি। আজ তার কিছু টাকা আনার কথা। আজ না আনলে আগামীকাল বাচ্চাদের স্কুলেও পাঠানো যাবে না। এই মাসটা তাও কোনোক্রমে পার হয়ে গেলা-সামনের মাসটায় কী হবে কে জানে! এ মাসে বাড়ি ভাড়া পুরোটা দেয়া হয় নি। এক হাজার টাকা কম দেয়া হয়েছে। সামনের মাসে বাড়ি ভাড়ার সঙ্গে এক হাজার টাকা বেশি দিতে হবে। বাড়তি এক হাজার টাকাটা আসবে কোথেকে?
এই বাড়িওয়ালা এমন না যে তাকে বাচ্চাদের মতো ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা যাবে। সে ঠিকই সামনের মাসে দু তারিখে সস্তা কিছু লিজেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হবে। হাসিমুখে ডাকবে রীনা বউমা কোথায়? রকেট-বুলেট কোথায়? এই দুজনকে দিনে একবার না দেখলে ভালো লাগে না।
টাকা-পয়সার এই অশান্তি রীনার অসহ্য বোধ হচ্ছে। কোনোখান থেকে একবার হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাওয়া গেলে খুচরা ঋণগুলো দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা যেত। সেই সম্ভাবনা নেই। হার্ডওয়ারের দোকানে আলাদীনের চেরাগ কিনতে পাওয়া যায় না। আলাদীনের চেরাগ ছাড়া এই সমস্যার কোনো দিন সমাধান নেই।
রীনার একটা ভারি নেকলেস আছে। তার দাদিজান বিয়ের সময় দিয়েছিলেন। পাঁচ ভরি সোনার পদ্মহার। দাদির স্মৃতিচিহ্ন। স্মৃতিচিহ্ন-ফিহী আবার কী? বেঁচে থাকাটাই সবচে’ বড় স্মৃতিচিহ্ন। হারটা বিক্রি করে দিতে হবে।
রীনা আবার হাসানের ঘরে ঢুকল। হাসান হাসিমুখে বলল, ভাবি জ্বরটা মনে হয় পুরোপুরি সেরে গেছে। একটু আগে একটা সিগারেট খেলাম।
ভালো। তোমার চা-টেস্ট এবং ডিম। চলে আসবে। শোন হাসান, তোমার তিন হাজার টাকা থেকে আমাকে কিছু ধার দিতে পারবে–শ পাঁচেক?
ভাবি তুমি পুরোটাই নিয়ে যাও। টাকাটার আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম পাওয়া যখন গেছে এটা তোমার।
আমি পাঁচ শ টাকাই নিচ্ছি বাকি টাকাগুলো দিয়ে তুমি দয়া করে কিছু ভালো কাপড়চোপড় বানাও। ইন্টারভু্যর সময় এলেই তোমার ভাইয়ের শার্ট-প্যান্ট নিয়ে তুমি দৌড়াদৌড়ি কর-আমার খারাপ লাগে। তোমার বয়েসী একটা ছেলের এক সেট ভালো কাপড়চোপড় থাকবে না, এটা কেমন কথা! আর শোন, ভালো একজোড়া জুতা তুমি অবশ্যই কিনবে। শার্ট ইন করে প্যান্ট পরবে, জুতা পরবে, চকচকে নতুন টাকার মতো স্মার্ট ভঙ্গিতে ইন্টারভু্য দিতে যাবে। তবেই না চাকরি হবে। লেবেন্ডিসের মতো ইন্টারভু্যু দিতে যাও বলেই তোমার কিছু হয় না। তুমি আমাকে দোকানে নিয়ে যেও। আমি দেখে শুনে তোমার জামাকাপড় কিনে দেব।
হাসান লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা।
রীনা টাকা হাতে বের হয়ে এল। তার লজ্জা লাগছে। টিউশ্যানি করে হাসান অল্প কিছু টাকাই পায় সেই টাকায় রীনাকে প্রায়ই ভাগ বসাতে হয়। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!! রীনা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ঠিক করে ফেলল পদ্মহারটা সে অবশ্যই বিক্রি করবে। সেই টাকায় একটা সেট পোশাক সে হাসানকে বানিয়ে দেবে। এটা হবে হাসানকে দেয়া তার উপহার। বাংলাদেশের দশটা ভালো ছেলের তালিকা তৈরি হলে হাসানের নাম সেখানে অবশ্যই থাকবে। এমন একটি ছেলেকে সামান্য উপহার দিতে না পারাটা খুব কষ্টের।
রীনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারটা একুশ বাজে। বাচ্চা দুটি এখনো ফিরছে না। কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয় নি তো! এত দেরি হবার তো কথা না। রীনার বুক ধড়ফড় করছে। কাল রাতে সে বাজে একটা স্বপ্নও দেখেছে—ঘরের ভেতর একটা হাতি ঘুরছে-ওঁড় দিয়ে আলনা থেকে টেনে কাপড় জামা নামাচ্ছে। স্বপ্নে হাতি দেখা খুব খারাপ। হাতির পিঠ কবরের মতো বলে হাতি দেখলে অতি প্রিয় কারো মৃত্যু হয়। রীনার হাতপা কাঁপছে। বারান্দার রেলিঙে একটা কাক বসে আছে। কী বিশ্ৰী ভঙ্গিতেই না সে তাকাচ্ছে! রীনা জানে এইসব কিছুই না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যাবে বাবা রিকশা করে ওদের নিয়ে আসছেন। সেই কিছুক্ষণটাই অনন্তকালের মতো দীর্ঘ মনে হবে। কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছাড়া মনের আনন্দে মানুষের বাঁচাটা কি এতই কঠিন?
বারান্দা থেকে সামনের রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। কমলার মারি এর মধ্যে চলে আসার কথা। দু হালি ডিম আর পাঁচ টাকার পান। কিনতে এত সময় লাগবে কেন? আবার কি কুকুরে কামড়েছে? চিঠির ব্যাগ হাতে পোস্টম্যান আসছে। রীনার বুক ধক করে উঠল। যদিও ধক করে ওঠার কারণ নেই। পোস্টম্যান নিশ্চয়ই তাদের বাসার দিকে আসছে না। আর আসলেই বা কী?