হুঁ।
রাত দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরাজ্বরি তো হবেই।
মাঝে মাঝে অসুখ-বিসুখ হওয়া ভালো, সেবা পাওয়া যায়।
অসুখ-বিসুখ ছাড়াই সেবা পাওয়ার লোক নিয়ে এসো–চোখ বন্ধ করে বসে আছ কেন? তাকাও।
আলো চোখে লাগছে ভাবি।
লাগুক। চোখ বন্ধ করে বসে থাকবে না। বিশ্ৰী লাগে। তোমার ভাইয়েরও একই অভ্যাস। খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা আর পা নাচানো। মনে হয় তার একটা পা স্প্রিঙের। বাতাস পেলেই দোলে।
হাসান চোখ মেলল। আলোটা এখন আর তেমন চোখে লাগছে না। শরীর ঘামছে, জ্বর মনে হয়। সত্যি সত্যি কমছে। তবে সিগারেট খাবার ইচ্ছা এখনো হচ্ছে না। যখন হবে তখন বুঝতে হবে। জ্বর পুরোপুরি কমে গেছে। হাসান রীনার দিকে তাকিয়ে হাসল। একবার ভাবল বলে–ভাবি আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। শেষ পর্যন্ত বলল না। রীনা ভাবির মুখ খুব আলগা–ফট করে এমন এক কথা বলবে যে অস্বস্তিতে মুখটুক শুকিয়ে যাবে। ভাবি সেটা নিয়ে দিনের পর দিন ঠাট্টা করে বেড়াবে। একদিন রীনা হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরেছিল, চুলগুলো ছিল ছাড়া। হাসান তাকে দেখে মুগ্ধ গলায় বলেছিল–তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন ভাবি? রীনা গভীর গলায় বলল, তুমি কি রবীন্দ্ৰনাথ?
তার মানে?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বউদির প্রেমে পড়েছিলেন। তোমারও মনে হয় সেই অবস্থা।
হাসান দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। রীনা সহজ ভঙ্গিতে বলল, চোখমুখ এমন করে ফেলেছ কেন? বউদিদের প্রেমে পড়া এমন কোনো ভয়াবহ অপরাধ না। এ দেশের সমাজ ব্যাপারটা সহজভাবেই দেখে। প্রেম খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছলে দেবরকে বিয়ে দিয়ে দেয়। বউয়ের সঙ্গে এক রাত কাটাবার পর সব প্ৰেম শেষ। প্রেমের সলির সমাধি হয় না–হয় বিছানা সমাধি।
রীনার রসিকতা এখানে শেষ হলেও হতো। শেষ হয় নি। সেদিনই রীনা হাসানের সামনে তার বড় ভাইকে বলল, ঘটনা শুনেছ? তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা তো আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাইকে এক্ষুনি বিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। আর দেরি করলে সে আমাকে প্ৰেমপত্র-টত্র লিখে ফেলবে। তখন যন্ত্রণা হবে। ইট ইজ হাই টাইম।
হাসানের লজ্জায় মরে যাবার মতো অবস্থা। এ জাতীয় বিপজ্জনক মহিলার সঙ্গে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হয়। হাসান খুবই সাবধানে কথা বলে। তারপরেও মাঝে মাঝে বিশ্ৰী ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।
রীনাকে আজ আসলেই খুব সুন্দর লাগছে। কে বলবে এই মহিলা ত্রিশ বছর পার করে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে হালকা পাতলা গড়নের এক কিশোরী–আজ মজা করে শাড়ি পরে বড় সেজেছে।
আজ কী বার ভাবি?
সোমবার।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ কেন?
সোমবার আমার জন্যে খুব খারাপ। ভয়াবহ সব সমস্যা হয় সোমবারে।
তোমার তো শুধু সোমবার খারাপ। আমার সব বারই খারাপ।
ভাবি চা খাব৷
শুধু চা?
চায়ের সঙ্গে একটা টেস্ট খেতে পারি। জ্বর মনে হয় কমে যাচ্ছে ভাবি। ঘাম দিচ্ছে।
ভেরি গুড–শোন তোমার টাকাটা ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। তুমি এত অসাবধান কেন?
হাসান বিস্মিত হয় বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না ভাবি কীসের টাকা?
কাল রাতে যে ভেজা প্যান্ট কলঘরে ছেড়ে এলে তার হিপ পকেটে তিন হাজার টাকা। রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা। কাপড় ধুতে গিয়ে ফুলির মা পেয়েছে–আমাকে দিয়ে গেছে।
বল কী?
বল কী মানে? টাকার কথা জানতে না? অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর হয়, অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড বেকার হয় বলে তো জানতাম না। কোথায় পেয়েছ এত টাকা?
টিউশ্যানির টাকা ভাবি। সুমি বলে একটা বাচ্চা মেয়েকে পড়াতাম। তিন মাসের টাকা এক মাসে দিয়ে চাকরি নটি করে দিয়েছে।
কেন?
পড়াতে পারি না। এই জন্যে বোধহয়।
পড়াতে পার না?
নাহ্–পড়াতে গিয়ে শুধু গল্প করি।
বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে এত কীসের গল্প?
বাচ্চাদের সঙ্গে গল্পই সবচে’ ইন্টারেস্টিং ভাবি। যা ইচ্ছা বলতে পারেন। ওরা মন দিয়ে শুনবে। বড়দের সঙ্গে গল্প করা খুব সমস্যা। প্রতিটি কথা ভেবেচিন্তে বলতে হয়।
আমার সঙ্গে গল্প করার সময়ও কি তুমি প্রতিটি কথা ভেবে চিন্তে বল?
রীনা ঠোঁট টিপে হাসছে। হাসান সাবধান হয়ে গেল। ভাবির মতলব ভাল নাকোনো একটা প্যাচে ফেলে দেবে।
চা খাব ভাবি।
চা, টেষ্ট, সিদ্ধ ডিম?
হ্যাঁ।
মাথাটা এগিয়ে আন তো জ্বরের অবস্থা দেখি। এ কী! লজ্জায় এমন লাল হয়ে যাচ্ছে–তুমি কি সত্যি সত্যি আমার প্রেমে পড়েছ নাকি? আশ্চর্য কাণ্ড!
রীনা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারটা প্ৰায় বাজে, আজ হাফকুল, বাচ্চাদের এগারটার মধ্যে চলে আসার কথা–এখনো আসছে না কেন? অস্পষ্ট কুয়াশার মতো দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যদিও রীনা জানে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাবা সঙ্গে আছেন। ট্রাফিক জ্যামট্যামে রিকশা নিশ্চয়ই আটকা পড়েছে।
আজ দুপুরে কী রান্না হবে সেটাও দেখতে হবে। বাজার হয় নি। রোজকার বাজার হাসান করে দেয়; আগে সপ্তাহের বাজার করে ফ্রিজে রাখা হতো। ফ্রিজ কাজ করছে না। নতুন গ্যাস ভরতে হবে। দোকান থেকে ডিম আনিয়ে ডিমের তরকারি করা ছাড়া উপায় নেই। ডিম আনানোর লোক নেই। কমলার মাকে পাঠানো যাবে না। তার বাড়ি থেকে বের হওয়া মানেই অ্যাকসিডেন্ট। রিকশার নিচে পড়ে যাওয়া, ড্রেনে পড়ে যাওয়াএকবার মাইক্রোবাসের ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে দুদিন ছিল হাসপাতালে। আরেকবার পান। কিনতে গিয়ে কুকুরের কামড় খেয়ে এল। মহাখালিতে নিয়ে নাভিতে ইনজেকশন–শতেক যন্ত্রণা।