এমন একজন কাজের মানুষকে শুধুমাত্র ঝগড়া করার স্বভাবের জন্যে কেউ বিদায় করে না। মানুষ এত বোকা না!
সকালের এই ব্যস্ততা, হট্টগোল হাসান তেমন টের পায় না। কারণ তার ঘুম ভাঙে নটার পরে। ততক্ষণে হইচই থিতিয়ে আসে। চারদিকে ঝড়ের পরের শান্ত অবস্থা বিরাজ করে। আজ জ্বরের কারণে সকাল ছটা থেকে সে জেগে। বাড়ির প্রতিটি শব্দ তার কানে আসছে। প্রবল জ্বরের সময় মানুষের কান তীক্ষ্ণ হয়। নিচু শব্দও অনেক বড় হয়ে কানে বাজে। হাসান বিড় বিড় করে নিজের মনেই বলল, হইহল্লাটা একটু কমানো যায় না? গড অলমাইটি বাড়িটা একটু শান্ত করে দিন। আমার ওপর একটু দয়া করুন। প্লিজ।
হইহল্লা কমল না, বরং বাড়তে থাকল। ঝনঝনি শব্দে থালা বা কাচের জগ ভাঙল। কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ একবার হয়েই থেমে যাবার কথা–এই শব্দ থামছে নাঝন ঝন করে বেজেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে থালাবাসনও টের পেয়েছে। এ বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ আছে। তাকে বিরক্ত করা তার পবিত্র কর্তব্য। এর মধ্যে লায়লা ঘরে ঢুকে বলল, দাদা তোর নাকি আকাশ-পাতাল জ্বর–ভাবি বলল।
হাসান জবাব দিল না। লায়লা সেন্ট মেখেছে, সেন্টের গন্ধে হাসানের গা গোলাচ্ছে। হাসান নিশ্চিত লায়লা আর কিছুক্ষণ তার ঘরে থাকলে সে বমি করে দেবে। যে কোম্পানি এই সেন্ট বানিয়েছে। সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়া দরকার।
দাদা দেখতে এই হলুদ শাড়িটা কি বেশি কটকট লাগছে?
হাসান ধমকের গলায় বলল, তুই ঘর থেকে যা তো। জাস্ট ক্লিয়ার আউট।
লায়লা হাসানের ধমকে বিস্মিত হলো না বা রাগও করল না। যেভাবে ঘরে ঢুকে ছিল, সেভাবেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তখন হাসানের মনে হলো একটা ভুল হয়েছে লায়লাকে দিয়ে জানালাটা বন্ধ করালে কাজ হতো। রোদটা আর চোখের ভেতর ঢুকে যেত না। কী বিশ্ৰী কী ভয়ংকর রোদই না। আজ উঠেছে! তরল রোদ। রোদের ভিসকেসিটি অনেক–গড়াতে গড়াতে কী সুন্দর চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে মাথাটা ভারি করে ফেলছে!
কলঘর থেকে কাপড় কাচার শব্দ এবং ফুলির মার গলাবাজি একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে–উচিত কথা আমারে শিখায়। আরো ধুমসী কাইলা মাগী–উচিত কথার ধার ফুলির মা ধারে না। তোর উচিত কথাত ফুলির মা খুক দেয়। থু থু থু।
রীনার গলা শোনা গেল— ফুলির মা চুপ কর তো।
ফুলির মার গলা আরো এক ধাপ উঠে গেল, আফা আমারে না–ধুমসী কাইলা মুঘীচুপ করতে কম। হের গলা পাও দিয়া চাইশ ধরেন। মালী আমারে উচিত কথা শিখায়।
ফুলির মা মাগী ফাগী বলবে না খবরদার!
মাগীরে মাগী বলব না তো কী বলব আফিা? ছাগী বলব? মাগীরে ছাগী বললে ছাগীরে কী বলব— বোতল বলব? আপনেই বলেন, আপনের বিচারটা কী হুনি।
চুপ কর।
আপনে চুপ করেন। অত গরম ভালো না। ফুলির মা গরমের ধার ধারে না।
হাসানের ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে–তোমরা দয়া করে চুপ করবে? দয়া করে কেউ একজন এসে আমার জানালা বন্ধ করবে? তোমরা কেউ বুঝতে পারছি না। আমার মাথার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।
হাসানের মনে হলো হঠাৎসব শব্দ কমে গেল। মাথার ভেতর জমে থাকা তরল রোগ হঠাৎ জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে গেল। হাসানের ঘুম ঘুম পেতে লাগল।
তার সত্যি ঘুম পাচ্ছে, না সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? প্ৰচণ্ড জ্বরে অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা সে অন্যের কাছে শুনেছে। তার বেলায় এই প্রথম ঘটছে। খুব খারাপ তো লাগছে। অজ্ঞানটা আরো আগে হতে পারলে ভালো হতো। হাসান জীণ গলায় ডাকাল–ভাবি, ভাবি।
মাথায় ঠাণ্ডা পানির ধারা। কেউ একজন চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কে পানি ঢালছে? চোখ মেললেই দেখা যায়–চোখ মেলতে ইচ্ছা করছে না। বাসায় পানি ঢালার মানুষ নেই। কমলার মা কি পানি ঢালছে? মনে হচ্ছে কমলার মা। তবে কমলার মা মাথায় পানি ঢাললেও চুলে বিলি কাটবে না। তাহলে কে? চোখ মেলে কি দেখবে? না, দেখতে ইচ্ছা করছে না। যার ইচ্ছা পানি ঢালুক কিছু যায় আসে না।
হাসান!
জ্বি ভাবি।
একটু কি ভালে লাগছে?
হুঁ।
তোমার জ্বর কত উঠেছে জান?
না।
এক শ পাঁচ। আমি বাড়িওয়ালাদের বাসা থেকে থার্মেমিটার। এনে জ্বর মেপে হতভম্ব! তুমি অচেতনের মতো হয়ে ছিলে। মুখ দিয়ে ফেনা টেনা বের হয়ে বিশ্ৰী কাণ্ড। উঠে বসতে পারবে?
উঠে বসতে হবে কেন?
দুটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিতাম। জ্বরটা কমত।
শুয়ে শুয়ে খেতে পারব। দাও ট্যাবলেট দুটা দাও।
গলায় আটকাবে তো?
আটকাবে না।
হাসান শোন, পুরো এক ঘণ্টা তোমার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে, গা স্পঞ্জ করা হয়েছে। আমার ধারণা জ্বর অনেকটা কমেছে। আমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে তোমাকে বসিয়ে দিচ্ছি। তুমি বসে প্যারাসিটামল খাও। ঘণ্টাখানিকের মধ্যে জ্বরটা আরো কমবে তখন নাশতা নিয়ে আসব। দাঁড়াও মাথাটা আগে মুছে দি।
হাসানকে ধরে উঠাতে হলো না, সে নিজেই উঠে বসল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। রীনা তার কোলে একটা বালিশ দিয়ে দিল। জ্বর কতটা কমেছে দেখতে পারলে হতো। সম্ভব না–কারণ থার্মোমিটার কিছুক্ষণ আগে টেবিল থেকে পড়ে ভেঙেছে। বাড়িওয়ালাকে এই জাতীয় আরেকটা থার্মোমিটার কিনে দিতে হবে। আজ দিনের মধ্যেই কিনতে হবে। সন্ধ্যার মধ্যে থার্মোমিটার পাঠানো না হলে লোক চলে আসবে। তাদের বাড়িওয়ালা কঠিন বস্তু।
এখন কি একটু ভালো লাগছে?