‘তিতলী শোন, আমি সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবি। সারাক্ষণ আমার ইচ্ছা করে তোমার হাত ধরে বসে থাকতে। সেই দিন কবে। যে আসবে আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। চল আমরা কোর্টে বিয়ে করে ফেলি–তারপর যা হবার হবে।
না হাসান এই জাতীয় কথাবার্তা কখনো লিখবে না। তার চিঠিগুলো হলো কাজের চিঠির মতো।
তিতলী ঘুমোতে এল। বৃষ্টি আরো প্রবল হয়েছে। তারা যখন সংসার করবে। তখন বৃষ্টির রাতগুলো ঘুমিয়ে নষ্ট করবে না। তিতলী মায়ের গায়ে হাত উঠিয়ে দিল। সুরাইয়া মেয়েকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নিয়ে বললেন, চিঠিতে কী লেখা যে একটু পর পর পড়তে হচ্ছে? তিতলীর হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। সুরাইয়া হাসলেন। অন্ধকারে সেই হাসি তিতলী দেখতে পেল না–সে গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকের কাছে চলে এল।
মে মাসের কড়া ঝাঁঝালো রোদ
মে মাসের কড়া ঝাঁঝালো রোদ এসে পড়েছে। হাসানের মুখের ওপর। রোদ ঠেকাবার জন্যে হাসানকে উঠে জানালা বন্ধ করতে হবে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। হাসানের বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নেই, জানালা বন্ধ করা তো অনেক পরের ব্যাপার। তার গায়ে এক শ তিন পয়েন্ট পাঁচ জ্বর। রীনা কিছুক্ষণ আগে জ্বর মেপেছে। জ্বর থার্মেমিটারে মাপা হয় নি, বাসায় থার্মেমিটার নেই। রীনা কপালে হাত রেখে গভীর গলায় বলেছে, এক শ তিন পয়েন্ট পাঁচ। জ্বরের ক্ষেত্রে রীনার অনুমান ভালো। জ্বর মনে হয় বাড়ছে। গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। মুখের ওপর রোদটা আগেও ছিল। তখন এতটা খারাপ লাগছিল না। এখন অসহ্য বোধ হচ্ছে। রোদটা মনে হচ্ছে তরল আকার নিয়েছে। মুখ থেকে গড়িয়ে চোখের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে।
হাসান কয়েকবার ডাকল, এদিকে কে আছে? এই এই! ডাক তেমন জোরালো হলো না কিংবা জোরালো হলেও কেউ শুনল না। সকালবেলার কয়েকটা ঘণ্টা বাড়ির লোকজন সীমাহীন ব্যস্ততায় থাকে। সকাল আটটা থেকে সাড়ে ন’টা এই দেড় ঘণ্টা সময়ের ভেতর তারেক অফিসের দিকে রওনা হন। অফিসে যাবার প্রস্তুতি পর্ব শেষ হতে তার পুরো এক ঘণ্টা লাগে। তিনি কোনো জিনিসই খুঁজে পান না। তার হাঁকডাক ক্ৰমাগত শোনা যেতে থাকে-আমার জুতার ভেতর মোজাজোড়া রাখলাম, একটা আছে আরেকটা গেল কোথায়? পরিষ্কার একটা রুমাল দিতে বললাম।—কথাটা কারো কানে যাচ্ছে না? এটা বলার জন্যে কি আমি মাইক ভাড়া করব? টেবিলের ওপর বড় একটা হলুদ খাম ছিল–খামের ওপর লাল কালি দিয়ে ‘Important’ লেখা। খামটা গেল কোথায়? একটু আগেও তো দেখেছি। খামের তো আর পা নেই যে হেঁটে হেঁটে মালিবাগ চলে যাবে?
তারেক সাহেবের দুই ছেলে রকেট ও বুলেটের স্কুল সাড়ে আটটায়। (আসল নাম মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এবং মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন। রকেট এবং বুলেট হাসানের ছোট ভাই রকিবের দেয়া নাম— এই নামেই তারা স্কুলে এবং বাসায় পরিচিত। তাদের সুন্দর ডাকনামও আছে টগর ও পলাশ। এই দুই নামে তাদের মা ছাড়া এখন আর কেউ ডাকে না।) তারা দু’জন এক বছরের ছোট বড় হলেও একই ক্লাসে পড়ে। যমজ ভাইদের মতো প্রতিটি কর্মকাণ্ড তারা একসঙ্গে করে। সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে দুজনেই বলে, ‘আজ স্কুলে যাব না।’ সাড়ে সাতটা থেকে আটটা এই আধঘণ্টা তাদের ওপর স্কুল যাত্রায় রাজি করানোর নানা প্রক্রিয়া চালানো হয়। কোনোটিই কাজ করে না। শেষ ওষুধ হিসেবে রীনা দু’জনের গালেই কষে চড় বসায়। দু’জন একই সঙ্গে গলা ছেড়ে কাদে। ক্ৰন্দনরত অবস্থাতেই তাদের প্রায় টেনেহেঁচড়ে রিকশায় তুলে দেয়া হয়। এদের স্কুলে পৌঁছে দেয়া এবং স্কুল থেকে আনার দায়িত্ব পালন করেন তাদের দাদুভাই আশরাফুজ্জামান সাহেব। কাজটা তিনি যে খুব আগ্রহের সঙ্গে করেন তা না। রিটায়ার্ড বাবা যদি ছেলের সংসারে বাস করতে আসেন তাহলে তাকেও কিছু কাজকর্ম করতে হয়। জগতে ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু নেই।
হাসানের ছোট বোন লায়লা জগন্নাথ কলেজে বি.এ. পড়ে। সে লাঞ্চবক্সে করে দুপুরের টিফিন নিয়ে যায়। তাকে এই সময় অত্যন্ত ব্যস্ত দেখা যায়। সে খুব সাজগোজ পছন্দ করে। তার ব্যস্ততা একই সঙ্গে সাজগোজের দিকে এবং টিফিন তৈরি হলো কি না। সেই দিকে। নিজের সাজগোজের ওপর লায়লার আস্থা খুবই কম। সাজের প্রতিটি পর্যায়ে সে তার ভাবির কাছে ছুটে যায়–ভাবির মতামত নিয়ে নিয়ে সাজের পরবতী ধাপের দিকে এগোয়, ভাবি টিপটা কি মাঝখানে হয়েছে? লাল টিপটাই পরব নাকি টিপ হাতে আঁকিব? ঠোঁটের লিপস্টিক কি বেশি কড়া হয়ে গেছে?
রীনা বিরক্ত হয় না। সাজসজ্জার ব্যাপারে অন্যকে পরামর্শ দেবার ব্যাপারে কোনো মেয়েরই বিরক্তি থাকে না। মেয়েরা এই কাজটা খুব আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে করে।
ঠিক ন’টার সময় ঠিকা কাজের মেয়ে ফুলির মা আসে। প্রতিদিনই তার সঙ্গে এ বাড়ির স্থায়ী কাজের মেয়ে কমলার মা’র একটা ঝগড়া শুরু হয়। কমলার মা নিচু গলায় ঝগড়া করলেও ফুলির মার গলা–কাকতাডুয়া গলা। সে চিৎকার শুরু করলেই আশপাশের কাক উড়তে থাকে। প্রতিদিনই একবার ঠিক করা হয় ফুলির মাকে আর রাখা হবে না। পাওনা গণ্ডী মিটিয়ে বিদায় করা হবে। বিদায় করা হয় না। কারণ ফুলির মার কর্মক্ষমতা অসাধারণ। ঝগড়া করতে করতেই সে অতি দ্রুত বাসনকোসন মেজে ঝকঝকে করে ফেলবে। পুরো বাড়ি ঝাঁট দেবে, কলঘরে রাখা দু বালতি কাপড় ধুয়ে চিপে দড়িতে শুকোতে দেবে। তার দায়িত্ব এই পর্যন্তই। দায়িত্ব পালনের পরেও সে যাবার আগে রীনাকে জিজ্ঞেস করবে, আর কোনো কাম আছে আফা। থাকলে তুরন্ত কন। এক বাড়িত কাম করলেই আমার শেষ না, আরো বাড়ি আছে। নিজের ঘর-সংসার আছে।