হাসান প্যান্টের পকেটে হাত দিল–টাকার বান্ডিলটা আছে তো? ডান প্যান্টের পকেটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা তিন হাজার টাকা আছে। তিনটা পাঁচ শ টাকার নোট, বাকি সব এক শ টাকার নোট। সুমির মা তাঁকে তিন হাজার টাকা দিয়েছেন। সুমিকে তিন মাস ইংরেজি এবং অঙ্ক শেখানোর পারিশ্রমিক। টাকা দেবার সময় ভদ্রমহিলা শুকনো মুখে বললেন, টাকাটা দিতে দেরি হলো কিছু মনে করবেন না। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম মেয়ের বাবা প্রতি মাসে টাকা পাঠান না, তিন-চার মাস পর পর একসঙ্গে পাঠান। হাসান হাসিমুখে বলল, কোনো অসুবিধা নেই। একসঙ্গে পেয়ে আমার বরং সুবিধাই হলো।
টাকাটা গুণে নিন।
গুণতে হবে না।
গুণতে হবে না কেন? অবশ্যই গুণতে হবে। গুণুন।
ভদ্রমহিলা সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাসান টাকা গুণল। সব চকচকে নতুন নোট। নতুন নোটের গন্ধ শুকে ভালো লাগে। ভদ্রমহিলার সামনে এই কাজটা করা যাবে না।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমার মেয়েকে আমি নিজেই পড়াব। আপনার আর আসার দরকার নেই।
হাসানের মন খারাপ হয়ে গেল। তার তিনজন ছাত্রছাত্রী আছে। তিন জনের ভেতর সুমি মেয়েটা অন্যরকম। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে টুকটুক করে গল্প করে। প্রতিটি গল্পই খুব মজার। বেণি দুলিয়ে যখন গল্প করে তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
স্যার, আমার বাবার যে অসম্ভব বুদ্ধি এই গল্পটা কি আপনাকে বলেছি?
না তো!
বাবার অসম্ভব বুদ্ধি। বুদ্ধিতে বাবার নাম্বার হলো এক শ-তে এক শ দশ।
এক শ-তে এক শ দশ কীভাবে হয়?
সবার জন্যে হয় না, বাবার জন্যে হয়।
তাই বুঝি?
হাঁ তাই। বাবার বুদ্ধি যে এক শ-তে এক শ দশ এটা কে বলে জানেন স্যার?
না জানি না। কে বলে?
আমার মা বলেন। আর কী বলেন জানেন?
জানি না।
আর বলেন–মানুষের এত বুদ্ধি থাকা ভালো না।
তোমার বুদ্ধি কেমন?
এখন আমার বুদ্ধি কম, তবে আমি যখন বড় হব তখন আমার বুদ্ধিও হবে এক শতে এক শ দশ। স্যার আসুন। এখন আমরা পড়াশোনা করি। অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছি তো মা টের পেলে রাগ করবেন।
হাসান টাকা গোণা শেষ করেছে। সুমির মা বললেন, রাবার ব্যান্ড দিচ্ছি, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নিন। আর শুনুন আমার মেয়েটা আপনাকে খুব পছন্দ করে। ওর বাবা বিদেশে–মেয়েটা একা একা থাকে, কথা বলার কেউ নেই। আপনি মাঝেমধ্যে এসে সুমিকে দেখে যাবেন।
জ্বি আচ্ছা। সুমিকে একটু ডাকুন। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই।
ওকে ডাকার দরকার নেই। আপনি চলে যাচ্ছেন সে জানে। কান্নাকাটি করতে পারে।
এতগুলো টাকা পকেটে থাকলে মনের বিষন্ন ভাব কেটে যায়! হাসানের কাটে নি। সে সুমিদের বাসা থেকে বের হবার সময় একবার ভাবল বলে–আমাকে কোনো টাকাপয়সা দিতে হবে না। আমি সপ্তাহে তিন দিন এসে আপনার মেয়েকে পড়িয়ে যাব। বলা হয় নি। লাজুক ধরনের মানুষ বেশির ভাগ সময়ই মনের কথা বলতে পারে না। মনের কথা হড়বড় করে শুধুমাত্র পাগলরাই বলতে পারে। পাগলরা সেই কারণেই মনে হয় সুখ।
বড় রাস্তায় নেমেই হাসান রিকশা পেয়ে গেল। একটা না, তিনটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই ঝিকাতলা যাবার জন্যে প্রস্তুত। হঠাৎ এ রকম সৌভাগ্যের কারণটা কী? সৌভাগ্যের পরই দুৰ্ভাগ্য আসে। তাকে কি পথে হাইজ্যাকার ধরবে? ধরতে পারে। ধরলে মানিব্যাগ হাতে তুলে দিতে হবে। মানিব্যাগে দুটা এক শ টাকার নোট আছে। ওরা হাসিমুখে মানিব্যাগ নিয়ে চলে যাবে। প্যান্টের পকেটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা তিন হাজার টাকার খোঁজ করবে না। তবে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে ঝড়বৃষ্টির রাতে দেখা হবার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। ঝড়বৃষ্টির রাতে তারা মজা করে নেশাটেশা করে। বৃষ্টিতে ভিজে হাইক্যাকিং করা রতাদের পোষায় না।
জ্বর সম্ভবত আরো বেড়েছে। হাসানের শরীর থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে রিকশায় পড়ে গেলে সমস্যা হবে। হাসান দু হাতে রিকশার হুড ধরে আছে। রিকশাওয়ালার হয়তো ধারণা হয়েছে সে রিকশা চালাচ্ছে না, স্পোর্টস কার চালাচ্ছে। রাস্তার পানি কেটে রিকশা শাঁ শাঁ করে এগোচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে আছে। গর্তখানা-খন্দ কিছুই চোখে পড়ছে না। হাসানের কেবলি মনে হচ্ছে কোনো একটা গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে যাবে।
রিকশাওয়ালাকে রিকশা আস্তে চালাতে বলতেও ইচ্ছা করছে না। হাসানের মনে হচ্ছে–তার কথা বলার শক্তিও নেই।
ঝিকাতলা গলির মুখে এসে রিকশা থামল। এরচে’ ভেতরে আর যাবে না। গলিতে একহাটু পানি। ছোটখাটো একটা খাল তৈরি হয়ে গেছে। স্রোতের মতো পানি বইছে–কল কল শব্দও হচ্ছে।
হাসান রিকশা ভাড়া মিটিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে রাবার ব্যান্ডে মোড়া তিন হাজার টাকার প্যাকেটটা নেই। রিকশার সিট খালি–পা রাখার জায়গাটাও খালি।
রিকশাওয়ালা বলল, ভাইজান আপনার কি শইল খারাপ?
হাসান ক্লান্ত গলায় বলল, হুঁ।
তাইলে টাইট হইয়া বহেন লইয়া যাই। জুম বৃষ্টি নামছে–সোভানাল্লাহ কী অবস্থা!
হাসান রিকশা থেকে নেমে গেল। রিকশায় টাইট হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। গলির নোংরা পানিতে পা টেনে টেনে হাসান এগোচ্ছে। বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙ্গে। হাসানের মনটা খুব খারাপ। তিন হাজার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। এই টাকার শোক ভুলতে তার দীর্ঘদিন লাগবে। তিতলী দুশ টাকা পেত, সেই টাকাটাও তাকে দেয়া হলো না। আবার কবে তার হাতে টাকা আসবে কে জানে!