সুরাইয়া সমস্যায় পড়ে গেলেন। মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে তিনি সামান্য মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা বলাটা ঠিক হয় নি। একটা মিথ্যা বললে পরপর কয়েকটা মিথ্যা বলতে হয়। সুরাইয়া ইতস্তত করে বললেন, জ্বর।।
জ্বর শুনে একেবারে ছেলেকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছি। টাইফয়েড-টয়েড হলে তো গুষ্ঠীসুদ্ধা খবর দিয়ে নিয়ে আসতে। আমাকে বল তো–এই বাড়াবাড়ির মানে কী?
আরেকটা মাছ নাও। আগেই ডাল নিলে কেন?
মতিন সাহেব আরেকটা মাছ নিলেন। জনপ্ৰতি একটা করে কই মাছ তিনি হিসেব করে নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়ে তাদের ফুফুর বাড়িতে গেছে। দুটা মাছ বেঁচে গেল। তিনি একটা নিতে পারেন। তারপরেও হাসানের জন্যে একটা থাকবে। মতিন সাহেব খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আজ তিনি একা শোবেন। সুরাইয়া তার মেয়ের সঙ্গে ঘুমোবে। আঠার বছরের মেয়েকে কখনো একা ঘরে শুতে দিতে নেই। আঠার বছরের মেয়ে হলো সাক্ষাৎ আগুন। আগুনের সঙ্গে সব সময় পানি রাখতে হয়। মেয়ের মা হলো সেই পানি। আগুন-পানি একসঙ্গে থাকলে বিপদ থাকে না।
হাসান লজ্জিত মুখে খেতে বসেছে। সুরাইয়া তিতলীকে বললেন, তুই খেতে বসে যা।
তিতলী বলল, আমি তোমার সঙ্গে খাব মা।
তিতলীর চোখ জ্বলজ্বল করছে। মনে মনে মাকে সে অনেকবার ধন্যবাদ দিয়েছে। মা এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পদের খাবার করে ফেলেছে। বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা, পটল ভাজা। সুরাইয়া বললেন, তুই হাসানকে দেখেশুনে খাওয়া; আমি দেখি তোর বাবার কিছু লাগে কি না।
তিতলী মনে মনে বলল, মা তুমি এত ভালো কেন? আমি কোনোদিনও তোমার মতো ভালো মেয়ে হতে পারব না। হাজার চেষ্টা করলেও পারব না।
হাসান কিছু খেতে পারছিল না। একটু ডিম ভেঙে মুখে দিল। বেগন ভাজা দিয়ে ভাত মেখে এক পাশে সরিয়ে রাখল।
তোমার প্রাইভেট টিউশ্যানি কেমন চলছে?
ভালো।
আর ওই যে জীবনী লেখার কাজ। লিখছ?
হুঁ।
ভদ্রলোকের নাম যেন কী?
হিশামুদ্দিন।
তাঁকে তুমি বল না কেন একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে। তাঁকে বল–স্যার আমি চাকরিও করব। আর ফাঁকে ফাঁকে আপনার জীবনীও লিখব।
হাসান জবাব দিল না। তিতলীর খুব ইচ্ছে করছে হাসানকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। সাহসে কুলোচ্ছে না, কখন হুট করে মা ধুকে পড়বেন। তাছাড়া হাত ছয়ে দেখতে হলে অজুহাত লাগে। তেমন কোনো অজুহাতও মাথায় আসছে না। ‘তোমার গালে এটা কী?’ এই বলে কি গালটা ছুঁয়ে দেখা যায় না?
তিতলী বলল, খাচ্ছ না কেন?
রুচি হচ্ছে না। জ্বর আসছে বোধহয়।
দেখি তো জ্বর কিনা!
তিতলী হাসানের কপালে হাত রেখে চমকে উঠল। জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে কেউ খেতে বসে? তার উচিত গায়ে চাদর জড়িয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকা। জ্বর নিয়ে তার আসার দরকার ছিল কী। সে তো তাকে আসার জন্যে খবর দেয় নি।
তোমাকে খেতে হবে না। তুমি হাত ধুয়ে ফেল।
হাসান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বেসিনের কাছে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল। তিতলী বলল, লেবু দিয়ে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দেব?
না।
জ্বর নিয়ে আসার দরকারটা ছিল কী?
তোমার টাকাটা নিয়ে এসেছি।
টাকার জন্য কি আমি মরে যাচ্ছিলাম?
এখন দিতে না পারলে পরে হাত খালি হয়ে যাবে। দিতে পারব না।
সামান্য দুশ টাকা–আশ্চর্য! খবরদার ওই টাকা তুমি আমাকে দেবে না। তোমার কাছে থাকুক সুদে-আসলে বাড়ুক।
বমি বমি লাগছে। তিতলী ঘরে পান আছে?
আছে। তুমি বসার ঘরে গিয়ে বোস। এ কী! তুমিতো দেখি ঠিকমতো হাঁটতেও পারছি না। বাসায় যাবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না, রিকশা নিয়ে চলে যাব।
তিতলী চিন্তিত গলায় বলল, এক কাজ কর-আজ থেকে যাও। বসার ঘরের খাটে মশারি খাটিয়ে দিচ্ছি। এত জ্বর নিয়ে তুমি কোথায় যাবে?
আরে না, তুমি কী যে বল! তোমার বাবা যদি ভোরবেলা উঠে দেখেন আমি শুয়ে আছি–তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দেবেন।
আমি মাকে বলি। মাকে বললেই মা ব্যবস্থা করে দেবে।
উনাকে কিছু বলবে না।
মা এত জ্বর নিয়ে তোমাকে কিছুতেই একা যেতে দেবে না।
উনাকে কিছু বলার দরকার নেই। তিতলী আমি যাচ্ছি।
পান। পান খাবে না?
উহুঁ।
বৃষ্টি পড়ছে তো, বৃষ্টির মধ্যে যাবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না।
জ্বর নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে?
হুঁ।
পাগলের মতো হুঁ হুঁ করছ কেন? ভালোমতো কথা বল।
হাসান হেসে ফেলল। তিতলীর অস্থিরতার মধ্যে শিশুসুলভ একটা ব্যাপার আছে, যা দেখতে ভালো লাগে।
হাসছ কেন?
জ্বর হলে হাসতেও পারব না?
জ্বর নিয়ে তুমি এলে কেন? কে তোমাকে আসতে বলেছে?
হাসান আবারো হাসল। তিতলী বিরক্ত মুখে বলল, কথায় কথায় হাসবে না।
আচ্ছা যাও হাসব না।
তিতলী হাসানের হাত ধরল। ধরেই থাকল। মা এসে দেখে ফেললে দেখবে। সে কিচ্ছু কেয়ার করে না। তার চোখে এখন পানি এসে গেছে। হাসানের হাত ধরলেই তিতলীর চোখে পানি আসে।
হাসান নিজেই দরজা খুলল। ভালো বৃষ্টি নেমেছে। বাতাস নেই। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরাসরি নেমে আসছে, বাঁকাভাবে আসছে না। বাতাস থাকলে বৃষ্টি ধরে যেত— বাতাস জলভর্তি মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যেত। আজ মেঘ উড়ে যাবে না। অনেক রাত পর্যন্ত বৃষ্টি পড়তেই থাকবে। আজ রাতটা হচ্ছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর রাত। হাসান বৃষ্টির ভেতর এগোচ্ছে। দরজা ধরে তিতলী দাঁড়িয়ে আছে। হাসানের ইচ্ছা করছে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তিতলীকে দেখে। ইচ্ছাটা সে চাপা দিল। মেয়েটার কান্না কান্না মুখ না দেখাই ভালো। হাসানের শরীর কাঁপছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। রবফের কুঁচির মতো গায়ে এসে লাগছে। চামড়া ভেদ করে ঠাণ্ডা ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। এমন প্রবল বৃষ্টিতে সুপ্রিয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হেঁটে হেঁটে পুরানা পল্টন থেকে ঝিকাতলা যাওয়া কি সম্ভব?