আমি আসব। কীভাবে জানতে?
আজ ঘুম থেকে উঠেই তিনটা শালিক দেখেছি। মুখ ধুতে কলঘরের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি বারান্দায় কাপড় শুকোবার দড়িতে দুটা শালিক বসে আছে। তারপর কী হয়েছে শোন–মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি আরো একটা শালিক এসে বসেছে। মোট তিনটা শালিক। তখনই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম–আজ তুমি আসবে।
তিনটা শালিক দেখলে কেউ আসে?
তিতলী গানের মতো গুনগুন করে বলল–
‘One for Sorrow
Two for joy
Three for letter
Four for boy.
প্রথমে দুটা শালিক দেখলাম— তার মানে আনন্দের কোনো ব্যাপার ঘটবে, তারপর দেখলাম তিনটা, অর্থাৎ চিঠি পাব। তুমি যখনই আস একটা চিঠি নিয়ে আসা। কাজেই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত তুমি আসবে। শাড়ি পরে কেমন সেজে আছি দেখছি না। রাত সাড়ে ন’টার সময় কেউ এমন সেজেণ্ডজে থাকে? এটা নতুন শাড়ি, আগে কখনো পরি নি। রংটা সুন্দর না?
খুব সুন্দর।
না দেখেই তুমি বললে খুব সুন্দর। বল তো কী রঙের শাড়ি?
চাপা রং।
গুড। হয়েছে। আমার চিঠি এনেছ?
হুঁ।
দাও।
হাসান পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিঠি বের করল। তিতলীর হাতে দিতে দিতে বলল, আজ উঠি {
তিতলী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এসেই উঠি উঠি করছি কেন? মা তোমাকে ভাত খেয়ে যেতে বলেছে।
তিতলী চিঠি মুঠোয় লুকিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার ঘর হলেও সে একা ঘুমোয় না। এই ঘরে দুটা খাট পাতা। দুটা খাটে তারা তিন জন ঘুমোয়। সে আর তার ছোট দু বোন–নাদিয়া, নাতাশা। নাদিয়া-নাতাশা আজ বড় ফুফুর বাসায় বেড়াতে গেছে, রাতে থাকবে। তিতলীরও যাবার কথা ছিল। ভোরবেলায় তিনটা শালিক না দেখলে সে অবশ্যই যেত। বড় ফুফুর বাসায় যেতে তার সবসময় ভালো লাগে।
চিঠি খুলে তিতলীর মন খারাপ হয়ে গেল। এতটুকু একটা চিঠি-এক সেকেন্ডে পড়া হয়ে যাবে। তিতলী চিঠিটা গালে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে, হাত-পা কাঁপছে। আশ্চৰ্য, এ রকম হচ্ছে কেন? হাসানের চিঠি তো সে আজ নতুন পড়ছে না। অনেকদিন থেকেই পড়ছে। হাসানের এই চিঠিটা তিয়াত্তর নম্বর চিঠি। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে না। পড়লেই তো ফুরিয়ে যাবে। এখন থাক, রাতে বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যাবে। ইচ্ছে করলে চিঠিটা বুকের ওপর রেখে ঘুমিয়েও পড়তে পারে। নাদিয়ানাতাশা কেউ নেই। ঘরটা আজ তার একার। আচ্ছা মানুষটা লম্বা একটা চিঠি লিখতে পারে না? উপন্যাসের মতো লম্বা একটা চিঠি। সে পড়তেই থাকবে পড়তেই থাকবে চিঠি ফুরাবে না। এমন লম্বা চিঠি যে রাতে ঘুমোতে যাবার সময় চিঠি পড়তে শুরু করল ভোরবেলা আযানের সময় চিঠি শেষ হলো।
তিতলী।
তিতলী চমকে উঠল। এমনভাবে চমকাল যে গালে ধরে রাখা চিঠি মেঝেতে পড়ে গেল। দরজার কাছে সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। তিতলীর বুক ধকধক করছে। মা কি চিঠিটা দেখে ফেলেছেন? মনে হয় না। চিঠি দেখলে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি তাকিয়ে আছেন তিতলীর দিকে। মা অবশ্যি দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। এইসব ছোটখাটো ভান মা খুব ভালো করেন।
সুরাইয়া বললেন, ঘরে একা একা কী করছিস?
কিছু করছি না মা।
তিতলী কী করবে বুঝতে পারছে না। পা দিয়ে চিঠিটা চেপে ধরবে? না যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? মা সামনে থেকে না। সরলে সে ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আগে চিঠিটা লুকোতে হবে।
তোর বাবাকে ভাত দিচ্ছি। তোর বাবার খাওয়া হয়ে যাক তারপর তুই হাসানকে খাইয়ে দে। এত রাতে না খেয়ে যাবে কেন?
আচ্ছা।
সুরাইয়া সরে যেতেই তিতলী ছোঁ মেরে চিঠিটা তুলে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল। তার বুকের ধুকধুকনি এখানো যায় নি। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মা চিঠিটা দেখেছে।
মতিন সাহেব প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন, এতদিনেও সামান্য ভাত ঠিকমতো রাঁধা শিখলে না। এটা এমন কী জটিল কাজ যে কুড়ি বছরেও শেখা যাবে না।
সুরাইয়া চুপ করে রইলেন। মতিন সাহেব বললেন, তোমাকে পোলাও-কোরমা, কোপ্তা-কালিয়া তো রাঁধতে বলি না। সামান্য ভাত–এটাও ঠিকমতো রাঁধবে না।
সুরাইয়া কোটা থেকে এক চামচ ঘি ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিলেন। মতিন সাহেব আগুনগরম ভাতের প্রথম কয়েক নলা ঘি দিয়ে খান। এই ঘি দেশ থেকে আসে।
মতিন সাহেব বললেন, রাতদুপুরে হাসান এসেছে কেন? তিতলীও দেখি ওর সঙ্গে গাবের আঠার মতো লেগে আছে। দু’জনে মিলে গুটুর গুটুর গল্প। ঘরের ভেতর বাং সিনেমা আমার খুব অপছন্দ। রাতদুপুরে সে আসবেই বা কেন?
সুরাইয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি আসতে বলেছি।
তুমি আসতে বলেছ? কেন?
শুনেছিলাম হাসানের মা’র খুব অসুখ ছিল–এখন কেমন তা জানার জন্যে আসতে বলেছিলাম।
কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো না। মা’র অসুখের খবর ছেলেকে রাতদুপুরে ঘরে এনে জিজ্ঞেস করতে হবে? মা’র অসুখের তুমি করবে। কী? তুমি সিভিল সার্জনও না, পীর ফকিরও না।
সুরাইয়া ক্ষীণ স্বরে বললেন, আরেক চামচ ঘি দেব?
দাও। আর শোন, তোমাকে বলছি, তোমার কন্যাদেরও বলছি–বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ না। বাড়াবাড়ি আমি খুব অপছন্দ করি। হাসানের মা’র খবর জেনেছ?
হুঁ।
তাহলে ওকে বসিয়ে রেখেছি কেন–চলে যাক না।
ভাত খেয়ে যেতে বলেছি।
ভাত খেয়ে যেতে বলেছ কেন?
সুরাইয়া প্ৰায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, এত রাতে না খায়ে যাবে!
মতিন সাহেব প্লেটে ডাল নিতে নিতে বললেন, তুমি সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা। বড়াবাড়ির ফল কখনো শুভ হয় না। হাসানের মা’র হয়েছে কী সেটা তো বললে না।