দরজার ছিটিকিনি খোলার শব্দ হচ্ছে। এ বাড়ির দরজার ছিটিকিনিগুলোও নষ্ট। সহজে খোলা যায় না, ধস্তাধস্তি করতে হয়। হাসান ভেবেছিল মতিন সাহেব দরজা খুলে শ্লেষজড়ানো বিরক্ত গলায় বলবেন, ও আচ্ছা তুমি? এত রাতে কী মনে করে? হাসানকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল তিতলী। এত রাতেও সে বেশ সেজেণ্ডজে আছে। চুল বাঁধা। পরনে চাঁপা রঙের শাড়ি। ঠোঁটে লিপস্টিকও আছে। গলায় চিকমিক করছে সরু চেইন। মনে হয় কোনো বিয়েবাড়ি থেকে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। তিতলী গভীর বিস্ময় নিয়ে বলল, আরো তুমি? এত রাতে তুমি কোথেকে?
রাত খুব বেশি নাকি?
সাড়ে ন’টা বাজে।
ভেতর থেকে মতিন সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস? তিতলী লাজুক গলায় বলল, হাসান ভাইয়া এসেছেন। বাবা। মতিন সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ও।
তিতলী হাসানের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার এত আনন্দ লাগছে। আনন্দে চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। শুধু পানি জমা না–আনন্দে শরীরও কাঁপছে। এই তো সে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়েছে। আঙুলগুলো সত্যি সত্যি কাঁপছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এস।
হাসান খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকল। এত রাতে এসে তিতলীকে বিব্রত করার কোনো মানে হয় না। তিতলীদের বসার ঘরের অবস্থা শোচনীয়। পুরনো সোফায় কয়েক জায়গায় গদি ছিঁড়ে তুলা বের হয়ে পড়েছে। একটা সোফার স্প্রিং নষ্ট। বসলে তলিয়ে যেতে হয়। দুটা বেতের চেয়ার আছে। চেয়ারের নানা জায়গা থেকে পেরেক বের হয়ে আছে। অসাবধানে চেয়ার থেকে উঠতে গেলে প্যান্ট বা শার্ট ছিড়বেই। হাসানের কালো প্যান্টটা এভাবেই ছিঁড়েছে। ঘরের অর্ধেকটা অংশ জুড়ে খাট পাতা। খাটে তোশক বিছানো আছে। তোশকের ওপর বেশির ভাগ সময় কোনো চাদর থাকে না। আজ অবশ্যি আধ্যময়লা একটা চাদর আছে। দেয়ালে গত বছরের একটা ক্যালেন্ডার। জুন মাস বের হয়ে আছে। ক্যালেন্ডারের ছবিটা সুন্দর। হ্রদের জলে মানের পোশাক পরা এক তরুণী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তরুণীর চোখ বন্ধ। হ্রদের জল যেমন নীল, তরুণীর স্নানের পোশাক তেমনি লাল। লাল-নীলে মিলে দারুণ একটা ছবি। ক্যালেন্ডারটার পাশেই একটা দেয়ালঘড়ি। ঘড়িটা আজ বন্ধ। সাতটা একুশ বাজছে। হাসান ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, তিতলী এক গ্লাস পানি খাব।
তিতলী পানি আনতে গেল। খাবার ঘরের টেবিলে পানির জগ এবং গ্লাস রাখা আছে। তিতলী সেদিকে গেল না। বাবা খাবার টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর মুখ সন্ধ্যা থেকেই থমথমে। এখন সেই থমথমে ভাব আরো বেড়েছে। তাঁর সামনে পড়লে তিনি কঠিন চোখে তাকবেন। সব সময় কঠিন চোখ দেখতে ভালো লাগে না।
রান্নাঘরে তিতলীর মা সুরাইয়া ভাত বসিয়েছেন। মতিন সাহেবের জন্যে আলাদা করে। ভাত রাঁধতে হচ্ছে। তিনি আতপ চালের ভাত খান। সেই ভাত বািরকারে হতে হয়। ভাতের প্রতিটি দানা থাকবে আলাদা। একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকবে না। পাকা রাধুনির জন্যেও কঠিন ব্যাপার। সুরাইয়া পাকা রাধুনি নন। স্বামীর ভাত রান্নার সময় তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে থাকেন। তিতলী রান্নাঘরে ঢুকতেই সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকালেন। তিতলী লজ্জামাখা গলায় বলল, হাসান ভাইয়া এসেছে মা। বলতে গিয়ে ত্রিতলীর কথা জড়িয়ে গেল, গাল খানিকটা লালচে হয়ে গেল। ব্যাপারটা সুরাইয়ার চোখ এড়াল না। সুরাইয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ওকে খেয়ে যেতে বল।
দরকার নেই মা।
তিতলী পানির গ্লাস নিয়ে বের হয়ে গেল। কেমন হড়বড় করে বের হচ্ছে। দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে খানিকটা পানি সে ছলকে ফেলে দিল। মেয়েটার অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখে সুরাইয়ার মন কেমন করতে লাগল। হাসানকে দেখলেই মেয়েটা এমন অস্থির হয়ে পড়ে কেন? কী আছে হাসানের মধ্যে? এ বছরও এম.এ. পরীক্ষা দেয় নি। প্রতি বছর শোনা যায় পরীক্ষা দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেয় না। হাসানের চেহারাও ভালো না। কেমন বোকা বোকা ভাব। সংসারের অবস্থা সাধারণ, ভাইয়ের সঙ্গে বাস করছে। চাকরি বাকরি কোনোদিন পাবে। এ রকম মনে হয় না। আজকাল চাকরি বাকরি হলো ধরাধরির ব্যাপার। হাসানের ধরাধরি করার কেউ নেই।
ভাতের পানি ফুটছে। সুরাইয়া ভাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে আজ ভাতে কোনো গণ্ডগোল হবে। ভাত গায়ে গায়ে লেগে যাবে। তিতলীর বাবা খেতে বসে নানান ধরনের কটু কথা বলবেন। সুরাইয়া তিনবার ‘ইয়া জালজালালু ওয়াল ইকরাম’ বলে হাঁড়ির ঢাকনা তুলে ফুঁ দিলেন।
হাসান এক চুমুকে পানিটা শেষ করে গ্লাস তিতলীর দিকে বাড়িয়ে বলল, তিতলী যাই।
তিতলী কিছু বলল না। মাথা নিচু করে হাসল। এমনভাবে হাসল যেন হাসান দেখতে না পায়। হাসানের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের একটা হচ্ছে তিতলীদের বাড়িতে এসেই সে প্রথমে এক গ্লাস পানি খেতে চাইবে। পানি খাওয়া শেষ হলে বলবে–তিতলী যাই। মুখে বলবে কিন্তু যাবার কোনো লক্ষণ দেখাবে না।
মা তোমাকে খেয়ে যেতে বলেছে।
আরে না।
আরে না কেন? খেয়ে যাও না। মেনু অবশ্য ভালো না–চোখে দেখা যায় না। এমন সাইজের কই মাছ। বাবার ধারণা কই মাছ সাইজে যত ছোট হয় তত স্বাদ বেশি হয়।
হাসান কিছু বলল না। তিতলী বলল, তুমি যে আজ আসবে এটা কিন্তু আমি জানতাম।