জীবন।
জ্বি স্যার?
মেয়েটির নাম কী?
কোন মেয়ের নাম স্যার?
হাসানের পছন্দের মেয়েটির নাম…
ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, নাম স্যার জানি না। তবে নাম-এড্রেস সব সংগ্ৰহ করতে পারব।
থাক সংগ্ৰহ করতে হবে না। আমি হাসানকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
হিশামুদ্দিন সাহেব টেলিফোন রেখে শোবার ঘরে ঢুকলেন। ঘর কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে আকাশে মেঘ করেছে। তাঁর হিসেব মতো বৃষ্টি হবার কথা রাত ন’টা-দশটার দিকে। এখুনি আকাশ এত অন্ধকার হলো কেন?
তাঁর ব্যক্তিগত বেয়ারা মোতালেব চায়ের কাপ নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঠিক সাড়ে চারটার সময় তিনি এক কাপ হালকা লিকারের চা খান। বিকেল পাঁচটায় অফিসে উপস্থিত হন। আজ নিয়ম ভাংতে ইচ্ছে করছে।
তিনি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, মোতালেব আকাশে কি মেঘ আছে?
মোতালেব বিস্মিত হয়ে বলল, জ্বি।
কী মনে হয় তোমার, বৃষ্টি হবে?
ঝুম বৃষ্টি হবে স্যার। আসমান অন্ধকার কইরা মেঘ করছে।
তুমি টেলিফোন করে জীবনকে জানিয়ে দাও যে আজ অফিসে যাব না।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঝুম বৃষ্টি যদি নামে তাহলে আজ বৃষ্টিতে গোসল করব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
হিশামুদ্দিন সাহেব লক্ষ করলেন মোতালেব তাঁর কথায় অবাক হলো না। মোতালেবকে এখন পর্যন্ত তিনি বিস্মিত হতে দেখেন নি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হিশামুদ্দিন সাহেব বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তাঁর খুব অস্থির লাগছে। অস্থির লাগছে কেন? তৃতীয় স্ট্রোকের সময় কি হয়ে গেছে? কপাল ঘামছে? পিঠের মাঝখানে ব্যথা বোধ হচ্ছে।
তিনি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। তাঁর কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কথা বলার জন্যে মোতালেবকে কি ডেকে পাঠাবেন? সে বিছানার কাছে এটেনশন হয়ে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে–তিনি কথা বলে যাবেন। তিনি ডাকলেন–মোতালেব।
মোতালেব ছুটে এল। তিনি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তার বাবার ফ্যান চুরির গল্পটা কি বলবেন? গল্পটা সে কীভাবে নেবে? সবাইকে কি সে বলে বেড়াবে–আমাদের স্যারের বাবা ছিলেন চোর। কথাগুলো সে বলবে ফিসফিস করে। যারা শুনবে তারাও অন্যদের কাছে ফিসফিস করবে।
মোতালেব।
জ্বি স্যার।
বৃষ্টি কি নেমেছে?
জ্বি না। স্যার।
আচ্ছা তুমি যাও–এক কাজ কর, টেলিফোন হ্যান্ডসেটটা দিয়ে যাও।
মোতালেব বের হয়ে গেল। হিশামুদিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরে টেলিফোন রাখেন না। টেলিফোন কেন–কিছুই রাখেন না। বিশাল একটা ঘর, ঘরের মাঝখানে প্ৰকাণ্ড একটা খাট-আর কিছু নেই। কাপড় বদলানোর জন্যেও তাকে পাশের ঘরে যেতে হয়। ফাঁকা একটা ঘরে রাতে যখন ঘুমোতে আসেন তখন তাঁর মনে হয় তিনি খোলা মাঠে শুয়ে আছেন।
টেলিফোন নিয়ে মোতালেব ঢুকাল না, ঢুকল রহমতউল্লাহ। শঙ্কিত গলায় বলল, স্যারের শরীর কি ভালো?
হিশামুদ্দিন বললেন, শরীর ভালো। তুমি টেলিফোন রেখে চলে যাও।
কাকে করবেন বলুন স্যার, আমি লাইন লাগিয়ে দি।
কাকে করব বুঝতে পারছি না। তুমি রেখে যাও।
ডাক্তার সাহেবকে কি খবর দেব স্যার?
না।
আজ রাত আটটায় আপনার ডিনারের দাওয়াত, চেম্বারস অব কমার্সের মিটিং। আপনি কি যাবেন?
আটটা বাজতে তো দেরি আছে–আছে না?
জ্বি স্যার।
আমি যাব। তবে বৃষ্টি নেমে গেলে যাব না। আজ বৃষ্টিতে ভিজব।
রহমতউল্লাহ অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। হিশামুদ্দিন বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। রহমতউল্লাহ গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। হিশামুদ্দিন বললেন, তুমি কিছু বলবে?
জ্বি না স্যার।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন সেট হাতে নিয়ে বসে আছেন। কাকে টেলিফোন করবেন? এমন কেউ যদি থাকত যার সঙ্গে সহজ স্বাভাবিকভাবে গল্প করা যায় তাহলে ভালো হতো। এমন কেউ নেই। ক্ষমতাবান মানুষরা ধীরে ধীরে কী পরিমাণ নিঃসঙ্গ হয় তা তিনি এখন বুঝতে পারছেন। তাঁর ক্ষমতা আরো বাড়বে–তাকে অর্থমন্ত্রী করার কথা হচ্ছে। প্রস্তাব এখনো সরাসরি আসে নি, তবে চলে আসবে। তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। পেছনের সিটে তিনি গা এলিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকবেন। ফাইল হাতে ড্রাইভারের পাশে তার চেয়েও বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকবে তার পিএস। পেছনের একটা গাড়িতে বসে থাকবে সিকিউরিটির লোকজন।
হাসানকে তাঁর বাবার গাড়িগ্ৰীতির গল্পটা বলা হয় নি। একদিন বলতে হবে। তাঁর বাবার গাড়িগ্ৰীতি ছিল অসাধারণ। কিছু টাকা-পয়সা যোগাড় হলেই তিনি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেলতেন। ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা শহরে ঘোরা।
মোতালেব ঘরে ঢুকল। হিশামুদ্দিন বললেন, কিছু বলবে মোতালেব?
বৃষ্টি নামছে স্যার।
বেশি নেমেছে না ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে?
ফোঁটা ফোঁটা।
যখন ঝুম বৃষ্টি নামবে তখন বলবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার। চা দিমু?
না।
হিশামুদ্দিন টেলিফোনের নাম্বার টিপছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ কিন্তু টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে না। মনে রাখার চেষ্টাও অবশ্য করেন না। টেলিফোন নাম্বারা মনে রাখার জন্যে তার লোক আছে। একটা টেলিফোন নাম্বারই তার মনে থাকে। মেয়ের নাম্বার। মেয়েকে টেলিফোন করে কি পাওয়া যাবে? সামারে সে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
কে? চিত্ৰলেখা?
বাবা তুমি!! কী ব্যাপার?
এত অবাক হচ্ছিস কেনা! আমি টেলিফোন করতে পারি না?
অবশ্যই পার। আমি সে জন্যে অবাক হচ্ছি না। আমার অবাক হবার কারণ ভিন্ন।