- বইয়ের নামঃ মেঘ বলেছে যাব যাব
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অবসর প্রকাশনা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
মেঘ বলেছে যাব যাব
একদল হাঁসের সঙ্গে সে হাঁটছে।
তার মানেটা কী? সে হাঁসদের সঙ্গে হাঁটবে কেন? সে তো হাঁস না। সে মানুষ। তার নাম হাসানুর রহমান। বয়স আটাশ। মোটামুটি সুদৰ্শন। লাল রঙের শার্ট পরলে তাকে খুব মানায়। সে কেন হাঁসদের সঙ্গে ঘুরছে?
হাঁসের দল জলা জায়গায় নেমে পড়ল। সেও তাদের সঙ্গে নামল। হাঁসিরা শামুক গুগলি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। সেও খাচ্ছে। কপি কপি করে খাচ্ছে। ঝিনুকের খোল খুলতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা হাঁস তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাঁসটার চোখ মানুষের চোখের মতো বড় বড়। কাজল পরানো। হচ্ছেটা কী? এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন? দুঃস্বপ্ন তো বটেই।
হাসান প্ৰাণপণ চেষ্টা করতে লাগল দুঃস্বপ্নটা থেকে জাগতে। হাঁস না, তাকে স্বাভাবিক মানুষ হতে হবে। শামুক খেতে তার অসহ্য লাগছে। দুঃস্বপ্নটা কাটছে নাবরং আরো গাঢ় হচ্ছে। জলা জায়গাটা এখন নদীর মতো হয়ে গেছে। নদীতে প্রবল স্রোত। সে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে ভাসছে–যদিও সে সাঁতার জানে না। ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন। স্বপ্লেই মানুষ আকাশে উড়তে পারে, প্ৰবল স্রোতেও স্থির হয়ে ভাসতে পারে।
আহ্ এই দুঃস্বপ্নের ঘুম ভঙে না কেন? হাসান পাশ ফিরল। পাশ ফিরতেই সিগারেট লাইটারের খোঁচা লাগল। পিঠে। সে চোখ মেলল। ভাগ্যিস পাশ ফিরেছিল। পাশ ফেরার কারণে ঘুম ভাঙল।
স্বপ্নের কর্মকাণ্ডের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। স্বপ্ন নিয়ে রাগ করারও কোনো মানে হয় না। কিন্তু হাসানের রাগ লাগছে। এমন উদ্ভট স্বপ্ন সে কেন দেখবে?
তার জীবনে উদ্ভট ব্যাপার অবশ্যি মাঝেমধ্যেই ঘটে। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই ঠেলাগাড়ির নিচে কেউ পড়ে নি। সে পড়েছে। মালিবাগ রেলক্রসিঙের কাছে হঠাৎ হুড়মুড় করে একটা ঠেলাগাড়ি তার গায়ে উঠে গেল। এক সময় সে বিস্মিত হয়ে দেখে ঠেলাগাড়ির দুই চাকার মাঝখানে সে প্রায় গিন্টু পাকিয়ে পড়ে আছে। চারপাশে প্রচণ্ড ভিড়। ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। পুলিশের সার্জেন্ট বাঁশি বাজাচ্ছে। ঠেলাগাড়ির নিচ থেকে তাকে বের করা মোটেই সহজ হয় নি। গাড়ি বোঝাই লোহার রড। সব রড নামিয়ে লোকজন ধরাধরি করে ঠেলাগাড়ি উঁচু করল, তারপরও সে বেরোতে পারল না। কারণ তার বা পা ভেঙে গেছে। তাকে পুরো এক মাস পায়ে প্লাস্টার বেঁধে শুয়ে থাকতে হলো। তার এম.এ. পরীক্ষা দেয়া হলো না। সেই পরীক্ষা এখনো দেয়া হয় নি। আবার কখনো দেয়া হবে–সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
হাসান বিছানায় উঠে বসল। তার ইচ্ছে করছে আগুনগরম এক কাপ চা খেতে। সবার বাড়িতে যদি খানিকটা হোটেল ভাব থাকত তাহলে ভালো হতো। খাটের পাশে টেলিফোন। টেলিফোন তুলে গষ্ঠীর গলায় বলা–হ্যালো রুম সার্ভিস! এক কাপ আগুনগরম চা৷
এ বাড়িতে সকালবেলা এক কাপ চা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর সবার জন্যে যখন গণ-চা হবে তখনই পাওয়া যাবে। তার আগে না।
রান্নাঘরে দু বার্নারের একটা গ্যাসের চুল। সকালবেলা গ্যাসের চাপ কমে যায়। একটা চুলা অনেক কষ্টে ধিকি ধিকি করে জ্বলে। সেই চুলায় নাশতা তৈরি হয়। রুটি-ভাজি, কিংবা রুটি-হালুয়া। হাসানের বড় ভাই তারেক ভাত খেয়ে অফিসে যান। তার জন্যে ভাত রান্না হয়। তারেকের দুই পুত্রের স্কুলের টিফিন বানানো হয়। চুলা কখনো খালি থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে সকালে বেড-টি চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবার কথা।
কোনো একটা ব্যাপার মাথার ভেতর ঢুকে গেলে সেটা আর বেরোতে চায় না। গ্রামোফোনের কাটা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকে। ‘এক কাপ আগুনগরম চা–এই বাক্য হাসানের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। হাসান বিছানা থেকে নামল। বাসার সামনের রাস্ত পার হলেই ইস্কান্দর মিয়ার চায়ের দোকান। এক কাপ চা চট করে খেয়ে আসা যায়। সকাল বেলার বিরক্তিকর কর্মকাণ্ড, যেমন–দাঁত ব্ৰাশ, দাড়ি কামানো আপাতত স্থগিত থাকুক।
হাসান লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরল। লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। রীনা ভাবি একগাদা কথা শুনিয়ে দেবে। রীনা ভাবির প্রেস্টিজজ্ঞান খুব বেশি।
বারান্দায় বের হতেই হাসান রীনার মুখোমুখি হয়ে গেল। রানার হাতে লাল রঙের প্লাষ্টিকের বালতি। বালতিভর্তি কাপড়। এই কাপড়ে সে নিজ হাতে সাবান মাখিয়ে কলতলায় রেখে আসবে। কাজের মানুষের হাতে সাবান ছেড়ে দিলে দুদিনে একটা করে সাবান লাগবে।
রীনা শান্ত গলায় বলল, হাসান তুমি আজ অবশ্যই তোমার কোটিপতি বন্ধু রহমানের বাড়িতে যাবে। তার দাদি খুব অসুস্থ। তিনি তোমাকে দেখতে চান।
আচ্ছা।
আচ্ছা না, অবশ্যই যাবে। রহমান কাল সন্ধ্যাবেলা এসে বলে গেছে। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। রহমানের দাদির ব্যাপারটা কী? উনি প্রায়ই তোমাকে দেখতে চান কেন?
জানি না ভাবি।
তোমার বন্ধু আজ যে গাড়ি নিয়ে এসেছিল, সেই গাড়ি গলি দিয়ে ঢোকে না। গলির মোড়ে রেখে আসতে হয়েছিল।
হাসান হাসল, কিছু বলল না। রীনা কলতলার দিকে রওনা হতে গিয়েও হলো না। হাসিমুখে বলল, আমি নতুন একটা শাড়ি পরেছি, তুমি তো কিছু বললে না।
নতুন শাড়ি?