শাহেদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, আমার কাছে শুধু ছবি বিক্রি করলে হবে না। আমাকে তুমি ছবি আঁকা শেখাবে।
অবশ্যই স্যার।
সপ্তাহে তিন দিন তুমি আমাকে শেখাবে। তার জন্যে তোমাকে যথাযত সম্মানী দেয়া হবে।
সম্মানীর কথা বলে আপনি আমাকে লজ্জা দেবেন না। আপনাকে যদি ছবি আঁকা শেখাতে পারি সেটাই হবে আমার সম্মানী।
তুমি পোট্রেট করতে পার?
পারি।
আমার বাবার, আমার এবং আমার মেয়ে মৃন্ময়ী এই তিনজনের তিনটা পোট্রট করে দেবে। প্রথমে মৃন্ময়ীরটা কর। আমার মেয়ের সঙ্গে কি তোমার পরিচয় হয়েছে?
জি না।
খুবই শার্প মেয়ে। আমি চাই মনের শার্পনেসটা যেন ছাবিতে আসে।
চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না স্যার।
চা চলে এসেছে। চার সঙ্গে সকালের সেই সমুচা। বাড়তি হিসেবে আছে কেক। বুঝাই যাচ্ছে দামী কেক। জহির কেক খেয়ে আরাম পাচ্ছে না। তার টেনশান একটাই— এই লোক পেমেন্টটা চেকে করবে না তো। চেকে করলে সাড়ে সর্বনাশ। একটা বেজে গেছে ব্যাংক বন্ধ। ঘরে আছে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। চাল-ডাল সবই কিনতে হবে। বাড়িতে মেহমান। প্রায় চার বছর পর ছোট বোনের সঙ্গে দেখা।
শাহেদুর রহমান সাহেব চেকে পেমেন্ট করলেন। এই কাজটা যে উনি করবেন তার আগেই বুঝা উচিত ছিল। বড় লোকরা বাসায় নগদ টাকা রাখে না বললেই হয়। তাদের আছে ক্রেডিট কার্ড। একশ পাতার মোটা মোটা চেক বই।
জহির চারতলা থেকে এক তলায় নেমেছে। ফরিদ তার সঙ্গে আছে। জহির বুঝতে পারছে না ফরিদকে তার সমস্যার কথা খুলে বলবে কি বলবে না। সব মানুষ নিজের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত, অন্যের সমস্যা তারা বুঝতে পারে না।
ফরিদ সাহেব।
জি।
আমার ছোট্ট একটা প্রবলেম আপনি সমাধান করতে পারবেন কি-না বুঝতে পারছি না। আপনার চেহারা দেখে মনে হয় আপনি কাইন্ড হার্টেড লোক।
বলুন কি সমস্যা।
স্যার চেক দিয়েছেন। আমার দরকার নগদ টাকা।
চেক কাল ভাঙ্গাতে পারবেন। ক্রশ চেক তো না। বাংকে জমা দিলেই টাকা পেয়ে যাবেন।
জহির বলল, আজকের দিনটা কীভাবে পার করব? আমার ছোটবোন তার মেয়ে নিয়ে খুলনা থেকে বেড়াতে এসেছে। মেয়ের দুধ আর কি কি যেন কিনতে হবে লিস্ট দিয়ে দিয়েছে। বাড়িওয়ালার বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাসের। আজ সন্ধ্যার মধ্যে কিছু-না-কিছু দিয়ে তাকে সামলাতে হবে। না হলে আত্মীয়স্বজনের সামনে অপমান করে ছাড়বে।
ফরিদ বলল, বুঝতে পারছি।
জহির বলল, বুঝতে পারছেন না। সমস্যা আপনাকে পুরোটা বলি নি। এখনও বাকি। ভাই কোনো ব্যবস্থা কি করা যায়?
আপাকে বলে দেখতে পারি। উনার কাছে কাশ থাকে।
আপা কে?
স্যারের মেয়ে মৃন্ময়ী।
আপনি কি গুছিয়ে বলতে পারবেন? না-কি আমি বলব? বরং একটা কাজ করন উনাকে বলুন জহির নামের একজন আর্টিস্ট কয়েক মিনিট কথা বলতে চায়। বলতে পারবেন না?
পারব।
জহির আবার আগের জায়গায় বসে আছে। সোফায় না, প্লাস্টিকের চেয়ারে। তার সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা করছে ধরাচ্ছে না। সিগারেট ধরালে গায়ে সিগারেটের গন্ধ লেগে থাকবে। মেয়েরা প্রেমিকদের গায়ে সিগারেটের গন্ধ সহ্য করে অন্যদেরটা করে না। সে পকেট থেকে মীনার দেয়া লিস্ট বের করল। লিস্টে এত কিছু লেখা এই প্রথম দেখল :
দুধ–-নেসলে এক কৌটা
হট ওয়াটার ব্যাগ
ডায়াপার (তিন বছরের)
এক কেজি কাল রঙের মিষ্টি
(টুনটুনি কালো মিষ্টি ছাড়া খায় না)
অলিভ ওয়েল
বেবি শ্যাম্পু
ফরিদকে আসতে দেখা যাচ্ছে। তার পেছনে কোনো নারীমূতি নেই। মৃন্ময়ী নামের তরুণী মনে হয় অপরিচিত কারো সঙ্গে দেখা করেন না।
জহির সাহেব। আপার ঘরের দরজা বন্ধ। উনার সঙ্গে কথা বলতে পারি নাই।
দরজা নিশ্চয়ই খুলবে। খুলবে না?
জি। সারা দিন তো আর দরজা বন্ধ করে রাখবেন না।
তাহলে অপেক্ষা করি।
জি আচ্ছা! আপনার তো মনে হয় টাকার খুবই প্রয়োজন। আমার কাছে এক হাজার টাকা আছে। ইচ্ছা করলে নিতে পারেন।
আপার কাছ থেকে সুবিধা না হলে আপনার কাছ থেকে টাকাটা নিতে হবে। খালি হাতে আজ ফেরাই যাবে না। ভাই আপনি মাঝে মাঝে খোঁজ নেবেন আপা দরজা খুলেছে কি-না। উনার মেজাজ কেমন?
ভালো।
বুদ্ধি কেমন?
বুদ্ধিও ভালো।
আপনার স্যারের চেয়ে বেশি না কম?
বেশি। উনার বুদ্ধি স্যারের বাবার মতো। তবে স্যারের বাবা গরম মাথার মানুষ। আপা ঠাণ্ডা মাথার।
চেহারা কেমন? আর্টিস্ট মানুষ তো, চেহারা কেমন জানতে হয়। উনার পোট্রেট করতে হবে।
চেহারা খুবই সুন্দর। আমি আমার জীবনে এত রূপবতী মেয়ে দেখি নাই।
বলেন কি!
টেলিভিশনে দেখি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা হয়। দুনিয়ার মেয়ে লাইন করে দাঁড়ায়। মৃন্ময়ী আপার কাছে এরা কিছুই না। এরা উনার নখের কাছেই আসতে পারবে না।
আপনি তো মনে হয় উনার প্রেমে পড়ে গেছেন।
আরে না। কী যে বলেন! ছিঃ!
ছিঃ! বলেন কেন? কত গল্প আছে বড় লোকের মেয়ে গাড়ির ড্রাইভারের প্রেমে পড়ে গৃহত্যাগ করেছে। আপনার পজিসন তো ড্রাইভারের চেয়ে উপরে। ভাই যান তো আরেক বার খোঁজ নিয়ে আসুন। দেখে আসুন বিশ্বসুন্দরী আপা দরজা খুলেছেন কি-না।
ফরিদ চলে গেল। জহির ঘড়ি দেখল। দুটা দশ। সে বাসায় দুপুরের কোনো খাবারের ব্যবস্থা করে আসে নি। চাল-ডাল অবশ্যি আছে। মীনা বুদ্ধি করে কিছু কি করে ফেলবে না? ডাল রাধল, ভাত ফুটালো, তার স্বামীকে দোকানে পাঠিয়ে এক হালি ডিম আনিয়ে নিল। কষানো ডিম, ডাল, ভাত। সহজ বাঙালি খাবার।