জহিরের হাতে রোল করা তিনটা ওয়াটার কালার। এর যে-কোনো একটা আজ দিনের মধ্যে বিক্রি করতে হবে। তিনটা ছবিই খাস্তা। জহির নিশ্চিত ভদ্রলোক এটা ধরতে পারবেন না। তিনটি ছবিতেই লোক-ভুলানো ব্যাপার আছে। ধবল বকের ছবি। গাঢ় রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে বকপাখির ধবল রঙ তুলে আনা হয়েছে। দেখতে ভালো লাগে এই পর্যন্তই। মনে কোনো ছাপ পড়ে না। ছবিতে গল্প নেই। রঙের কারিগরি আছে। চোখকে ফাঁকি দেয়ার ব্যাপার আছে। এর বেশি কিছু না।
চা নিয়ে একজন ঢুকেছে। আলাদা প্লেটে সমুচা জাতীয় কিছু। বড় লোকদের বাড়ির চা সব সময় ঠাণ্ডা হয়। অভাজনদের জন্যে তারা হেলাফেলা করে চা বানায়। দুধ নিতে সময় নেয়, চিনি দিতে সময় নেয়, চামচ নাড়তে সময় নেয়। এর মধ্যে চা হয়ে যায় পানি। মুখে নিয়েই থু করে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে।
ঠাণ্ডা চা মনে করে চুমুক দিয়ে জহিরের মুখ পুড়ে গেল। আগুন-গরম চা। তবে চা-টা হয়েছে ভালো। চায়ের পাতা যে দামি বুঝা যাচ্ছে। চমৎকার গন্ধ আসছে। হতে পারে সরাসরি বাগান থেকে আনা চা। এদের হয়তো কয়েকটা বাগান আছে। বনেদী ধনি।
বনেদী ধনিরা সহজে পয়সা বের করতে চায় না। নতুন যারা ধনি হচ্ছে তাদের খরচের হাত ভালো থাকে। নব্য ধনীরা তিনটা ছবিই কিনে ফেলবে। তাদের থাকে জমা করার নেশা। যা দেখবে তাই কিনে জমাবে। কি জমাচ্ছে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।
আসুন। স্যার ফ্রী হয়েছেন। চার তলায় যেতে হবে। স্যার চারতলায়। বসেন।
লিফট আছে না?
লিফট নেই।
এমন জমকালো চারতলা বাড়ি। লিফট নেই এটা কেমন কথা?
বাড়িটা স্যারের বাবার বানানো। উনি লিফট পছন্দ করেন না। একবার লিফটে চার ঘণ্টা আটকা পড়েছিলেন সেই থেকে উনার লিফট-ভীতি। উনি যে কয়টা বাড়ি বানিয়েছেন কোনোটার লিফট নেই।
আপনার স্যারের কি চায়ের বাগান আছে?
স্যারের চায়ের বাগান নেই। উনার বাবার আছে। পুরোটা না শেয়ারে। বাগান বিক্রি হয়ে যাবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।
আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?
আমি স্যারের এসিসটেন্ট, কাম ম্যানেজার।
আপনাকে তো অনেকবার উপর-নিচ করতে হয়।
জি। অবস্থা কাহিল। কি করব চাকরি।
আপনার নামটা জানা হলো না।
আমার নাম ফরিদ। ফরিদ হোসেন।
জহির বলল, আমার নাম তো আপনাকে একবার বলেছি। আবার কি বলব?
ফরিদ বলল, না বলতে হবে না। আপনার নাম আমার মনে আছে। জহির। আর্টিস্ট জহির। ছোটবেলায় আমি ভালো আর্ট করতে পারতাম। এখনও হাতী, বাঘ এইসব আঁকতে পারি।
ভেরি গুড।
আপনার উঠতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমার অবস্থা চিন্তা করেন। দিনের মধ্যে সতেরো-আঠারো বার উঠা নামা করি। আপনাকে যেই স্যারের কাছে হাওলা করে দিব। স্যার সঙ্গে সঙ্গে বলবেন চা আন। আবার নিচে যাও।
উপরে চায়ের ব্যবস্থা নাই?
জি না। কিচেন এক তলায়। স্যার ধোয়ার গন্ধ সহ্য করতে পারেন না বলে উপরে কিচেন নেই। ঝামেলা আর কারোর না, আমার। একবার হিসাব করেছিলাম সারাদিনে আঠারো বার উঠা-নামা করেছি। ঐটাই আমার রেকর্ড।
আজ দিনে এখন পর্যন্ত কতবার উঠানামা করলেন।
আজকেরটার হিসাব নাই।
জহিরের মনে হলো ম্যানেজার ছেলেটা শুধু যে ভালো তা-না। বেশ ভালো।
শাহেদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো জহির। কেমন আছ?
স্যার ভালো আছি। তিনটা ছবি আপনার জন্য এনেছি। দেখেন পছন্দ হয় কি না।
ওয়াটার কালার?
জি, ওয়েল কালার করব কিভাবে? রঙই কিনতে পারি না, রং, বোর্ড।
রঙ কেনার টাকার টানাটানি হলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে। নো প্রবলেম।
স্যার থ্যাংক ইউ। ছবিগুলি কি দেখাব?
আগে চা খেয়ে নেই। তারপর না ছবি। ফরিদ চা আন।
জহির ফরিদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্যার আমার চা না হলেও চলবে। চা খেয়ে এসেছি।
আরেকবার খাও। ফরিদ! দাঁড়িয়ে আছ কেন? চা দিতে বললাম না।
ফরিদ ছুটে বের হয়ে গেল।
শাহেদুর রহমানের তিনটা ছবিই পছন্দ হলো। জহির বলল, বক পাখি নিয়ে একটা সিরিজের মতো করেছি। বিভিন্ন সময়ে উড়ে যাওয়া বকের ছবি। সিরিজের নাম দিয়েছি উড়ে যায় বকপক্ষী।
নামও তো সুন্দর। তুমি তোমার এই সিরিজের কোনো ছবি আমাকে না দেখিয়ে বিক্রি করবে না।
অবশ্যই না।
তিনটা ছবির জন্যে তোমাকে কত দেব বল তো?
জুহির অতি দ্রুত চিন্তা করছে। দাম বেশি চেয়ে ফেললে এই শিল্পবোদ্ধা হয়তো বলে বসবে কিনব না। একবার একটা দাম বলে ফেললে দাম কমানোও যায় না। ছবিতে আর মাছ না যে দাম নিয়ে মুলামুলি চলবে। জহিরের আপাতত পনেরো হাজার টাকা হলেই চলবে। বাড়ি ভাড়ার চার হাজার, মুদির দোকানের দুই হাজার। ফজলুর কাছে ধার আছে চার হাজার, পুরোটা না দিলেও চলবে অর্ধেক তো দিতে হবে। ছোট বোন তার মেয়ে আর স্বামী নিয়ে খুলনা থেকে বেড়াতে এসেছে। তিন-চার দিন থাকবে। জন্মের পর ভাগ্নিকে জহির এই প্রথম দেখবে, তাকে একটা কিছু দিতে হবে। সোনার আংটি বা চেইন। সোনার ভরি এখন কত কে জানে।
শাহেদুর রহমান বললেন, কী ব্যাপার কিছু বলছ না কেন?
জহির বলল, স্যার আপনি যা দেবেন তাই আমি নেব।
ত্রিশ হাজার দিলে চলবে? পার পিস দশ?
স্যার আমি তো আগেই বলেছি। আপনি যা দেবেন আমি তা-ই নেব। আপনি যদি বলতেন, জহির আমি তোমাকে কিছুই দেব না। তুমি তিনটা ছবি রেখে যাও। আমি ছবি রেখে হাসিমুখে চলে যেতাম। আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।
বিশ্বাস করছি। কেন বিশ্বাস করব না।