বিন্তি বাথরুম থেকে ঘুরে এসে কাঁদো কাদো মুখে বলল, নাই আফা।
মৃন্ময়ী হাই তুলতে তুলতে বলল, জানতাম পাওয়া যাবে না।
আপা এখন কী হইব?
মৃন্ময়ী বলল, হইব আবার কি? বল হবে। প্রশ্নটা ঠিকমতো আরেক বার PI
আপা এখন কী হবে?
কিছুই হবে না। কি আর হবে? টেলিফোনটা দাও। বিন্তি টেলিফোন এনে দিল। তার হাত-পা কাঁপছে। কী ভয়ংকর ঘটনা অথচ আপা কত স্বাভাবিক যেন কিছুই হয় নি।
হ্যালো ছন্দা।
হ্যাঁ! আবার কোনো ঘটনা ঘটিয়েছিস? তোর টেলিফোন পেলেই বুকে ধাক্কার মতো লাগে। বল কী ঘটিয়েছিস?
আমি কিছু ঘটাইনি। আমার কাজের মেয়েটা ঘটিয়েছে। বাথরুমে বেসিনের উপর আমার নাকফুলটা রেখেছিলাম। এখন দেখি নেই। হীরের নাক ফুল।
বলিস কি! এই মেয়ে কতদিন ধরে আছে?
সপ্তাহখানেক হবে।
রেফারেন্স আছে, না রেফারেন্স ছাড়া রেখে দিয়েছিস?
জানি না রেফারেন্স আছে কি-না। ম্যানেজার সাহেব জানেন।
ওকে ভালো করে সার্চ কর। ওর জিনিসপত্র দেখ। ওকে একা সার্চ করলে হবে না, তোদের বাড়িতে ওয়ার্কিং ক্লাস যারা আছে সবাইকে সার্চ কর। ওদের মধ্যে এক ধরনের আন্ডারস্ট্যানডিং থাকে। একজন চুরি করে অন্যজন লুকিয়ে রাখে।
ভালো বুদ্ধি।
পুলিশের ভয় দেখিয়ে দেখ। নতুন এসেছে তো পুলিশ-ভীতি থাকবে।
পুলিশের ভয় দেখানো যেতে পারে। মেয়েটা কি রকম বদ শোন, আমাকে বলছে নাকফুলটা নাকি তুই নিয়েছিস।
কী!
সে কসম কেটে বলছে। এই শ্রেণী তো আবার কীরা-কসম কাটতে ওস্তাদ।
আমার কথা বলছে! মৃন্ময়ী লজায় আমার তো মরে যেতে ইচ্ছা করছে। ছিঃ ছিঃ! সে দেখলো কিভাবে আমি নিয়েছি? একবার বাথরুমে গিয়েছি। দরজা ছিল বন্ধ।
মৃন্ময়ী বলল, সে বলেছে সে কিছুই দেখে নি।
তাহলে?
বিন্তি বলছে তুই এ-বাড়িতে আসার পর সে বাথরুমে ঢুকে নি। তুই ছাড়া এটা না-কি কেউ নিতেই পারে না। তার লজিকও ফেলে দিতে পারছি না।
ছন্দা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কী বললি! মৃন্ময়ী তুই কী বললি!
মৃন্ময়ী বলল, তুই নাকফুলটা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে দে।
আমাকে এ রকম একটা কথা তুই বলতে পারলি? Of all persons you?
মৃন্ময়ী হেসে ফেলে বলল, ঠাট্টা করছি।
ছন্দা কাদো কাঁদো গলায় বলল, ঠাট্টা?
মৃন্ময়ী বলল, হ্যাঁ ঠাট্টা। আচ্ছা তুই ঠাট্টা নিতে পারিস না কেন? আমি ঠাট্টা করতে পারব না?
ছন্দা বলল, আমি আসলেই এ ধরনের ঠাট্টা নিতে পারি না। আমি তোর কাছে আর কোনোদিন আসব না প্রমিজ।
মৃন্ময়ী খিলখিল করে হাসছে। তার পাশে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বিন্তি। এই বড়লোকদের ঠাট্টা-তামশার নমুনা? নাকফুল আর উদ্ধার হবে না?
বিন্তি!
জি আপামণি।
ছন্দা আমার অতি প্রিয় বান্ধবী। তাকে আমি খুব পছন্দ করি।
জি আচ্ছা।
মেঝে ঘষাঘসি বন্ধ করে চলে যাও। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি পড়ব। কেউ যেন আমার ঘরে না ঢুকে। দুপুরে আমি শুধু একটা স্যান্ডউইচ খাব। স্যান্ডউইচ তুমি আমার ঘরে দিয়ে যাবে। Now clear out.
বিন্তি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
জহির অনেকক্ষণ হলো বসে আছে
জহির অনেকক্ষণ হলো বসে আছে। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেটা বসার ঘর না। অতি বিত্তবানদের বসার ঘরে অনেক কায়দা-কানুন থাকে। ইন্টোরিয়ার ডেকোরেটরা কালার চার্ট দেখে ঘর সাজান। হট কালার, কোল্ড কালার, অনেক জটিলতা। এই ঘরে কোনো জটিলতা নেই।
বসার সোফা আছে। সোফার কভার ময়লা। একটা জায়গায় সেলাই খুলে গেছে। কিছু প্রাস্টিকের সস্তা চেয়ারও আছে। ঘরের মাঝখানে লম্বা একটা টেবিল। টেবিল থেকে বার্নিশের গন্ধ আসছে। মনে হচ্ছে টেবিলটা বার্নিশ করা হচ্ছে। বার্নিশমিস্ত্রী এখনও আসে নি। এলেই কাজ শুরু হবে।
দেয়ালে গত বৎসরের একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। অতি বিত্তবানদের ঘরে ক্যালেন্ডার থাকে না। এদের আছে কেন বুঝা যাচ্ছে না। কাছেই মনে হয় রান্নাঘর। ভাজাভুজির গন্ধ আসছে।
সোফা থাকা সত্ত্বেও জহিরকে বসানো হয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ারে। জহিরের গালের খোচাখোচা দাড়ি— এর কারণ হতে পারে। যে পাঞ্জাবিটা তার গায়ে সেটা সে গত দুদিন ধরেই পরে আছে। পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ আসার কথা। প্যান্টটা অবশ্যি ইস্ত্রি করা। পায়ের স্যান্ডেলের অবস্থাও ভালো। তারপরেও জহিরের ধারণা তার চেহারায় সাহায্যপ্রার্থী ভাব কোনো-না-কোনোভাবে এসে গেছে। সাহায্যপ্রার্থীকে কেউ সোফায় বসায় না। তার জন্যে বেতের মোড়া খোজা হয়।
যে ভদ্রলোক জহিরকে বসিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছেন তার আচার-আচরণ অবশ্যি ভালো। চেহারায় কোমলতা আছে। বিনয়ী কথাবার্তা। বড়লোকদের মাঝে মাঝে বিনয়ী হতে দেখা যায় কিন্তু বড়লোকদের বাড়ির কাজের লোকদের মধ্যে এই জিনিস নেই। জহির তাকে বলেছে স্যারকে আমার নামটা বলবেন। নাম বললেই চিনবেন। আমার নাম জহির। বলবেন আর্টিস্ট জহির।
ভদ্রলোক বললেন, (হাসি মুখে) আপনার কি কোনো কার্ড আছে?
আমার কোনো কার্ড নেই। স্যার আমাকে বলেছিলেন যে-কোনো একদিন চলে আসতে। এপয়েন্টমেন্ট লাগবে না। উনি আমার একটা ছবি কিনেছিলেন। আমি নতুন ছবি নিয়ে এসেছি।
স্যার খুবই জরুরি কিছু কাজ করছেন। ব্যাংকের কাজ। একটু দেরি হবে।
দেরি হলে সমস্যা নেই।
চা খাবেন?
চা খেতে পারি।
চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ভদ্রলোক উধাও হয়েছেন পনেরো মিনিট আগে।
চা এখনো আসে নি। জুহির সিগারেট ধরালো। তার আগে দেখে নিল সোফায় পাশের সাইড টেবিলে এসট্রে আছে। এসট্রেতে বেশ কিছু সিগারেটের শেষ অংশ। সে প্লাস্টিকের চেয়ার ছেড়ে সোফায় বসল। সিগারেট হাতে এসট্রের কাছাকাছি বসাই যুক্তিযুক্ত।