শায়লার ঘরের দরজা-জানালা শুধু যে বন্ধু তা না— দরজা-জানালার উপর ভারী পরদা টানানো। এসি থেকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে, হিউমিডিফায়ার বিজ বিজ করছে। তিনি চোখের উপর লেবুর পানি মেশানো ভেজা টাওয়েল দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। ধবধবে সাদা বিছানার মাঝখানে সবুজ শাড়ির সরল রেখা। মৃন্ময়ী দরজা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিচু গলায় ডাকল, মা ঘুমাচ্ছ?
শায়লা বললেন, আগে দরজা বন্ধ কর। আলো আসছে। চোখে আলো লাগছে।
মৃন্ময়ী বলল, আমি তোমার ঘরে ঢুকব না মা। তোমার ঘরে ঢুকলে মনে হয় অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছি। তোমার শরীর এখন কেমন?
নিচেরটা পঁচানব্বই।
পালস কত? পালস নেমে গেছে।
মা শোন, আমি পরশু দিন ঠিকমতোই পরীক্ষা দেব। তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বস।
শায়লা চোখ থেকে টাওয়েল সরিয়ে উঠে বসলেন। কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, তুই এ-রকম পাগলামি করিস কেন?
কেন করি জানি না মা।
কাছে এসে একটু বস তো।
মৃন্ময়ী মার পাশে এসে বসল। শায়লা বললেন, সকালে নাশতা খাবার সময় তোর বাবাকে কেমন দেখলি?
ভালোই তো দেখলাম। নরম্যাল দেখেছিস?
হুঁ। অ্যাবনরমাল দেখার কথা?
তার বাবা টাকা-পয়সার বিরাট ঝামেলায় পড়েছে। ব্যাংক-লোনের কী জানি সমস্যা। আমাকে খোলাখুলি কিছু বলছে না।
বাবার কোনোকিছু নিয়ে তুমি শুধুশুধু দুশ্চিন্তা করবে না। বাবার মাথার উপর দাদাজান আছেন। দ্য গ্রেট মিস্টার মুশকিল আসান। এখন আমাকে বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট দাও।
কেন?
ভয় নেই খাব না। তুমি ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়া মেয়ে, আমি না।
তুই কেমন মেয়ে?
আমি তোমার মতো পুতুপুতু না, বাবার মতো রঙিন ফানুসও না। আমি আলাদা।
তুই বিয়ে করবি কবে?
কাউকে মনে ধরছে না। যেদিন কাউকে মনে ধরবে ধুম করে বিয়ে করে ফেলব। মা আমাকে ঘুমের ট্যাবলেট দাও।
ওষুধের বাক্স থেকে নে। নীল রঙের ট্যাবলেটগুলি ঘুমের।
মৃন্ময়ী ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে নিজের ঘরে ফিরল। বিন্তি কফির মগ-হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃন্ময়ী বলল, কফি খাব না। বিন্তি মগটা আছাড়া দিয়ে ভেঙে ফ্যাল। হা করে তাকিয়ে থাকবে না। যা করতে বলছি কর।
বিন্তি মগ ভাল।
মগ ভাঙার দশ মিনিটের মাথায় ছন্দা ঘরে ঢুকল। সে চোখ কপালে তুলে বলল, ব্যপার কী রে? এ কী অবস্থা! হয়েছে কী?
মৃন্ময়ী ফোপানোর মতো করে বলল, বিন্তি তুমি সামনে থেকে যাও।
বিন্তি পালিয়ে বাঁচল। কি সব জটিল কাণ্ডকারখানা শুরু হয়েছে। এখানে না থাকতে পারাই ভাগ্যের ব্যাপার।
মৃন্ময়ী বলল, ছন্দা তুই আমাকে একটু সাহস দিবি? আমি বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট হাতে নিয়ে বসে আছি। সাহসে কুলাচ্ছে না বলে খেতে পারছি না। মৃন্ময়ী হাতের মুঠা খুলে ঘুমের ট্যাবলেটগুলি দেখাল।
ছন্দা হতভম্ব গলায় বলল, Oh my God!
মৃন্ময়ী বলল, কেন আমাকে মরতে হচ্ছে সেটা আমি একটা কাগজে চিঠি লিখে গেছি। কাগজটা আমার টেবিলের ড্রয়ারে আছে। পুলিশি কোনো হাঙ্গামা যদি হয় তুই কাগজটা বের করে পুলিশের হাতে দিবি।
আমি একটু পড়ে দেখি?
মৃন্ময়ী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আচ্ছা পড়ে দেখ। কেউ যেন চিঠির। বিষয়ে কিছু না জানে।
গড প্রমিজ কেউ কিছু জানাবে না। আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলব না।
প্রমিজ।
প্রমিজ।
ক্রস মাই হার্ট।
ক্রস মাই হার্ট।
মৃন্ময়ী ড্রয়ার খুলে খাম এনে ছন্দার হাতে দিল। ছন্দা চোখ বড় বড় করে পড়ল। কাগজের মাঝামাঝি সবুজ কালিতে একটা লাইন লেখা–
আমার মৃত্যুর জন্য আমার প্রিয় বান্ধবী ছন্দা দায়ী।
পুলিশ ইচ্ছা করলে তাকে ধরতে পারে।
সাত দিনের রিমান্ডেও নিতে পারে।
ছন্দা বলল, এর মানে কী?
মৃন্ময়ী বলল, এর মানে ঠাট্টা।
ছন্দা বলল, কোনটা ঠাট্টা?
মৃন্ময়ী বলল, সবটাই ঠাট্টা। ঘুম ভেঙে তোকে দেখতে ইচ্ছা করল। তখন এই আইডিয়া মাথায় এসেছে। গতরাতে তোকে নিয়ে বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে আমরা দুজন নৌকায় করে গ্রামের এক হাটে উপস্থিত হয়েছি। হাটভর্তি মানুষ। আমাদের নৌকা পাড়ে ভিড়তেই হাট ভেঙে সবাই পাড়ে উপস্থিত। বিরাট হইচই। কারণ আমাদের দুজনের কারও গায়েই কিছু নেই। একটা সুতা পর্যন্ত না।
ছন্দা বলল, স্বপ্নটা এইমাত্র তুই বানিয়েছিস। ঠিক না? মৃ
ন্ময়ী বলল, হ্যাঁ।
তোর প্র্যাকটিক্যাল জোকস, পাগলামি এইসব আমি নিতে পারি না। আমি উঠলাম।
বেশি রাগ করেছিস?
না।
ছন্দা প্রায় ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল। ফিরেও এল ঝড়ের বেগে। বিছানায় ব্যাগ ছুড়ে ফেলে বলল, দুপুরে তোর সঙ্গে খাব। তোদের ঐ বাবুর্চিটা আছে না? রহিমার মা। তাকে রূপচান্দার শুঁটকি রান্না করতে বল। একবার খেয়েছিলাম তার স্বাদ মুখে লেগে আছে।
মৃন্ময়ী বলল, রূপচান্দা শুঁটকি ছাড়া আর কী খাবি?
কইমাছের ঝোল। আর টকের একটা আইটেম রান্না করতে বল তো! টক খেতে ইচ্ছা করছে।
ওকি ড়ুকি। শুঁটকি, কইমাছ, টকের আইটেম পাশ।
নতুন একটা মেয়ে দেখলাম। তোর কাজের মেয়ে?
হুঁ।
চেহারা সুন্দর তো! নাম কী?
নাম বিন্তি। ওর মায়ের নাম শাহেরা, সৎমায়ের নাম চিন্নাই বিবি। বোনের নাম মিন্তি। শুধু বাবার নামটা জানি না। বাবা বিন্তি মিন্তি দুই মেয়েকে মায়ের ঘাড়ে ফেলে আলাদা সংসার করেছে বলে এই ব্যাটার নাম জিজ্ঞেস করি নি।
ছন্দা বলল, আমার দেখা অতি অদ্ভুত কয়েকটি মেয়ের মধ্যে তুই একটা।
মৃন্ময়ী বলল, তুই অতি অদ্ভুত মেয়ে একটাই দেখেছিস। আমি। আমি ছাড়া আরেক জনের নাম কিন্তু তুই বলতে পারবি না।