ম্যানেজার কালাম কাদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার আপনি যা বলবেন তাই শুনব, কিন্তু গেট খুলব না।
আমার হুকুম এখন আর চলবে না?
স্যার! আপনার হুকুম অবশ্যই চলবে কিন্তু আমি গেট খুলব না।
আলিমুর রহমান পুকুরঘাটে গিয়ে বসলেন। সারারাত বসে রইলেন। পরের দিনও বসে রইলেন। কিছুই খেলেন না। রাত আটটায় শাহেদুর রহমান এসে বললেন, বাবা গেট খুলে দিয়েছি আপনি যেতে চাইলে যান।
আলিমুর রহমান বললেন, থ্যাংক য়্যু।
শাহেদুর রহমান বললেন, আমার প্রতি কি আপনার কোনো আদেশ আছে?
আলিমুর রহমান বললেন, মীনা নামের একটা মেয়ের জন্যে আমি দানপত্রে কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম সে যেন তা পায়।
শাহেদুর রহমান বললেন, বাবা আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার দানপত্র অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। শুধু ভিক্ষুক নিমূল পালন করা যাবে না, কারণ আপনিও তো ভিক্ষুক। তা হলে তো আপনাকেও জাহাজে করে দ্বীপে ফেলে দিয়ে আসতে হয়।
আলিমুর রহমান বললেন, ভিক্ষুক দেখতে পারি না, কারণ আমার বাবা ছিলেন ভিক্ষুক। হাটবারে ভিক্ষা করতেন।
শাহেদুর রহমান বললেন, আপনার সঙ্গে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। আর হয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। ভাত দিতে বলি?
দিতে বল। আর শোন জহির নামের যে আর্টিস্ট ছেলে আছে তার সঙ্গে মৃন্ময়ীর বিয়ে দেয়া যায় কিনা দেখিস। ছেলেটাকে কোনো কারণ ছাড়াই আমার পছন্দ হয়েছে।
শাহেদুর রহমান বললেন, বাবা আপনার হাতটা একটু ধরি?
আলিমুর রহমান বললেন, না।
তিনি রাত এগারোটায় আনন্দের সঙ্গেই গৃহত্যাগ করলেন।
জহির ছবি আঁকছে
জহির ছবি আঁকছে। টুনটুনি তার সামনে বসে আছে। সে গভীর আগ্রহে ছবি আঁকার কর্মকাণ্ড দেখছে। শিশুরা যেমন করে এটা-সেটায় হাত দেয়, তা করছে না। একবার শুধু রঙের টিউবের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, জহির কঠিনচোখে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
মীনা ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণ ছবি আঁকা দেখল। মেয়ের পাশে বসতে বসতে বলল, ভাইয়া কীসের ছবি আঁকছ?
জহির বলল, বিরক্ত করিস না।
বিরক্ত করছি না তো। কীসের ছবি আঁকছ জিজ্ঞেস করলাম।
আঁকা শেষ হোক তখন দেখবি।
ভাইয়া চা খাবে? চা দেব?
না।
মীনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, টুনটুনিকে একটু দেখে রেখো। আমি জরুরি একটা চিঠি লিখছি।
জহির জবাব দিল না।
মীনা চিঠি লিখছে জহিরকেই। গত দুদিন ধরে লেখা হচ্ছে। চিঠি আগাচ্ছে। গতকাল যতটুকু লেখা হয়েছে, সেটা ফেলে দিয়ে নতুন করে লিখছে। হাতের লেখা ভালো হয় নি। কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা দেখলে ভাইয়া বিরক্ত হতে পারে। তার প্রধান সমস্যা লাইন সোজা হয় না। রুলটানা কাগজ হলে সুবিধা হতো। স্টেশনারি দোকানে গিয়েছিল রুলটানা কাগজ পাওয়া যায় নি। আজকাল মনে হয় রুলটানা কাগজের চল উঠে গেছে। মীনা চিঠিটা শুরু করেছিল—
ভাইয়া
আমার সালাম নিও।
এইটুক লিখে মনে হয়েছে আমার সালাম নিও বাক্যটার প্রয়োজন নেই। সে যদি খুলনায় থাকতো তা হলে লেখা যেত। তারা দুজন তো একই বাসায় থাকে। আমার সালাম নিও বা তুমি কেমন আছ? এইসব লেখা অর্থহীন। সে চিঠিটা আবার নতুন করে শুরু করেছে।
ভাইয়া,
তুমি আমার মেয়ে টুনটুনিকে দেখতে পার না কেন? সেকি কোনো দোষ করেছে? না-কি সে দেখতে খারাপ? নাক বোচা, গায়ের রঙ কালো। এতদিন তোমার সঙ্গে আছি তুমি একটা দিনও টান দিয়ে মেয়েকে কোলে নাও নি, বা গালে হাত দিয়ে আদর কর নি। ঐ দিন মেয়েটার এমন জ্বর উঠল— মাথায় পানি দিলাম, জলপট্টি দিলাম। তুমি শুধু জিজ্ঞেস করলে, জ্বর কি বেশি? আমি রাগ করে বললাম, জ্বর বেশি না। সামান্য মাত্র একশ তিন। তুমি টুনটুনির কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা পর্যন্ত দেখলে না।
প্রতিদিন বাইরে থেকে বাসায় আস। কখনও তোমার ভাগ্নির জন্য একটা কিছু এনেছ? একটা চকলেট কিংবা একটা লজেন্স। চকলেট বা লজেন্স কেনার টাকা তোমার নাই এটা ঠিক না। তোমার যে জিনিসটা নাই তার নাম ভালোবাসা।
তুমি টুনটুনিকে দেখতে পার না এর জন্যে আমার মনে খুব কষ্ট। কারণ টুনটুনিকে আমি তো তোমার হাতেই রেখে যাচ্ছি। বাকি জীবন তুমিই তো তাকে দেখবে। আর কে দেখবে? তোমাকে বিষয়টা পরিষ্কার করে বলি।
ভাইয়া সবুজ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। খবরের কাগজে উঠেছে। তুমি তো খবরের কাগজ পড় না, তাই জান না। আমি বাড়িওয়ালার বাড়িতে গিয়ে রোজ কাগজ পড়তাম। সবুজের বিষয়ে কাগজে কিছু উঠে কি-না জানার জন্যেই পড়তাম। কাগজে লিখেছে সবুজ তার অপরাধের কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। পুলিশের মার খেয়ে মিথ্যাকে সত্যি বলছে এটা তো বুঝাই যাচেছ। কিন্তু কোর্ট তো এইসব বুঝবে না। জজ সাহেব ফাসির হুকুম দিয়ে বসবেন। তারা তো ফাঁসি দিয়েই খালাস। তখন আমার কী হবে? আমি কীসের আশায় বেঁচে থাকব?
তোমার না হয় ভালোবাসা নাই। কারো জন্য তোমার কিছু যায়-আসে না। কি আমার তো আছে। ভাইয়া, সারারাত আমি জেগে বসে থাকি। আমার ঘুমাতে ভয় লাগে। ঘুমালেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখি। সবুজকে ধরাধরি করে কিছু লোক নিয়ে যাচ্ছে ফাসি দেবার জন্যে। আর সে চিৎকার করছে, ময়না আমাকে বাঁচাও! ময়না আমাকে বাঁচাও!
ভাইয়া! আমি তাকে কীভাবে বাচাব? আমার হাতে কি কোনো ক্ষমতা আছে। আমি অতি সামান্য একটা মেয়ে, যার কেউ নাই। যার একমাত্র ভাই পর্যন্ত তাকে দেখতে পারে না।
আমি বারোটা ঘুমের ট্যাবলেট কিনেছি। বারোটাতেই কাজ হবে। এরচে বেশি খেলে সমস্যা হয়। সবুজের সঙ্গে রাগারাগি করে আমি একবার আঠারোটা খেয়ে ছিলাম পরে বমি হয়ে সর্ব বের হয়ে গেছে। খালি পেটে বারোটা খেলে বমি হবে না।