ভেতরে আসন।
ফরিদ মগ নিয়ে ঢুকল। মৃন্ময়ী বলল, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলুন। আমি দাদাজানকে দেখতে যাব।
জি আচ্ছা! ম্যাডাম আমার একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
বলুন।
রাত সাড়ে এগারোটায় টেলিফোন করা বিষয়ে। আমি টেলিফোন করি না।
একবার তো বলেছেন। আবার কেন?
আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই। এইজন্য আবার বললাম। আমি প্রমাণ দিতে পারি যে টেলিফোন আমি করি নাই।
মৃন্ময়ী বলল, কী প্রমাণ?
ফরিদ হড়বড় করে বলল, আমি যদি টেলিফোন করতাম তা হলে যেদিন আমাকে ধরলেন তারপর থেকে টেলিফোন করা বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু তারপর টেলিফোন করা বন্ধ হয় নাই।
মৃন্ময়ী বলল, আপনি কীভাবে জানলেন টেলিফোন করা বন্ধ হয় নি?
ফরিদের মাথা ঝুলে পড়ল।
মৃন্ময়ী বলল, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সামনে থেকে যান। ঐ দিনের মতো চৌকাঠে বাড়ি খাবেন না। সাবধানে যান।
ফরিদ সাবধানেই বের হলো। তার মন খুবই খারাপ। টেলিফোন সে করে না। কী করে মৃন্ময়ী ম্যাডামকে এই কথাটা বুঝাবে? তার ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। তাতে লাভ কী?
আলিমুর রহমান আমবাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন। আজ তাঁর গায়ে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবি পরেছেন। লুঙ্গির রঙও গেরুয়া। হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো অস্থিরতা নেই। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি চিন্তিত কিংবা বিষণ্ণ।
মৃন্ময়ী অনেকক্ষণ হলো এসেছে। সে বাংলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছে। বারান্দায় দুটা চেয়ার মুখোমুখি। মাঝখানে টেবিল। ম্যানেজার কালাম পট ভর্তি চা রেখেছে। মৃন্ময়ী চা ঢালে নি। সে দাদাজানের জন্য অপেক্ষা করছে। মৃন্ময়ী যে এসেছে তিনি জানেন। দূর থেকে দেখেছেন। হাত নেড়েছেন। আলিমুর রহমানের নির্দেশ আছে আমবাগানে হাঁটাহাঁটির সময় কেউ তার কাছে আসতে পারবে না। এই সময় তিনি কিছু জটিল চিন্তা করেন।
আলিমুর রহমানের জটিল চিন্তা মনে হয় শেষ হয়েছে। তিনি এগিয়ে আসছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি।
মৃন্ময়ী আছিস কেমন? ভালো।
তোর জন্যে আমি নতুন একটা নাম ঠিক করেছি মীন। মীন হলো মাছ। মৃন্ময়ী কঠিন নাম। মাছ অনেক সহজ। তোর বাবা যেন তাকে কী ডাকে?
BB ডাকে। Blue Bird.
গাধা তো! গাধা মার্কা নাম দিয়েছে।
দাদাজান চা খাবে?
হুঁ।
মৃন্ময়ী চা ঢালতে ঢালতে বলল, আমবাগানে হাঁটতে হাঁটতে জটিল চিন্তা কী করলে?
আলিমুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, ঠিক করেছি বাকি জীবন ভিক্ষা করে পার করব। দুপুর বেলা এর-তার বাড়িতে থালা নিয়ে উপস্থিত হব। কান্নাকান্না গলায় বলব, মাগো চাইরটা ভাত দেন। তোদের বাড়িতেও একদিন যাব।
তোমার ভিক্ষুক জীবন কবে থেকে শুরু হচ্ছে?
যে কোনোদিন শুরু হয়ে যেতে পারে। আজ বিকেলেও বের হয়ে পড়তে পারি।
মৃন্ময়ী চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমার মাথা তো আসলেই খারাপ।
আলিমুর রহমান বললেন, এই দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের মাথাই খারাপ। কারোর এক দাগ খারাপ, কারোর দুই দাগ খারাপ। আমার পুরোটাই খারাপ।
বাবা পাওয়ার অব এটর্নি বের করে খুব ভুল তাহলে করে নি?
যা করেছে। ঠিকই করেছে। গাধাটা যে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজটা করেছে এতেই আমি খুশি।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান তুমি কোর্টে যাও। আমি থাকব তোমার সঙ্গে। তোমার রোজগারে তোমার কোনো অধিকার থাকবে না এটা কেমন কথা?
কোনো দরকার নাই। ঝোলা হাতে রাস্তায় নামব। ভাবতেই মজা লাগছে। কেউ কিছু বলতেও পারবে না, কারণ আমি পাগল মানুষ।
মৃন্ময়ী বলল, তুমি সত্যি সত্যি ভিক্ষা করতে বের হবে?
অবশ্যই। আমবাগানে হাঁটাহাঁটি করে এইটাই ভাবছিলাম। ভিক্ষা করার এই আইডিয়া কার কাছ থেকে পেয়েছি জানিস? ফজলুর কাছ থেকে।
ফজলু কে?
জহিরের আর্টিস্ট বন্ধু। যাকে চিকিৎসার জন্যে বাইরে পাঠানোর কথা। ভালো কথা, সব ব্যবস্থা করেছি। ঐ ছেলে হয়ত চলেও গেছে। ছেলেকে দেখতেও গিয়েছিলাম। বাঁচার কোনো কারণ নেই। দেশে মরার বদলে সে মরবে বিদেশে। এইটুকু যা লাভ।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান আমি কি তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?
আলিমুর রহমান বললেন, পারিস।
মৃন্ময়ী বলল, তুমি এইখানেই থাকবে। এখান থেকে বের হবে না। আমি এসে তোমার সঙ্গে বাস করব।
আলিমুর রহমান শান্ত এবং স্পষ্ট স্বরে বললেন, না। গাধাপুত্রের দয়ায় আমি বাস করব না। মীন শোন, আমি এইমাত্র ঠিক করলাম আজ রাতেই গৃহত্যাগ করব। ভিক্ষার ঝুলি হাতে বের হব।
মৃন্ময়ী বলল, ভালো।
আলিমুর রহমান আনন্দের হাসি হাসতে হাসতে বললেন, পোষাকও ঠিক করে ফেলেছি। লুঙ্গি এবং একটা চাদর।
মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, দাদাজান আমি এখন উঠব। তোমার উদ্ভট কথা শুনতে আর ভালো লাগছে না।
ঢাকায় রওনা হবার আগে আগে মৃন্ময়ী ম্যানেজার কালামকে ডেকে বলল, আমি গেট দিয়ে বের হবার পর পর আপনি গেটে তালা লাগিয়ে দেবেন। দাদজান যেন বের হতে না পারেন। উনার মাথা এখন পুরোপুরি খারাপ। উনি ঠিক করেছেন পথে পথে ভিক্ষা করবেন। এটা করতে দেয়া যাবে না। আপনার প্রধান কাজ উনাকে এই কম্পাউন্ডে আটকে রাখা। ঠিক আছে?
জি ঠিক আছে।
সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রাখবেন। যেন পালাতে না পারেন।
আমি বুঝতে পরছি আপা।
কোনো রকম সমস্যা হলে আমাকে টেলিফোন করবেন। কিংবা বাবাকে।
জি আচ্ছা।
আলিমুর রহমান সন্ধ্যাবেলা বের হতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তাকে আটকে রাখা হয়েছে।