মাঝে মাঝে সিস্টেমের বাইরে যেতে হয়। আমি ঠিক করেছি সপ্তাহে এক দিন কোনো বই পড়ব না। খবরের কাগজও না।
তাতে লাভ?
চোখের রেস্ট। ব্রেইনের রেস্ট। আজ আমার রেস্টের দিন। দেখি এক কাপ চা বানিয়ে দে। মেয়ের হাতে বানানো চা কেমন হয় টেস্ট করে দেখি।
মৃন্ময়ী চায়ের কাপ হাতে নিজের ঘরে ঢুকেছে। ঘর কিছুটা নোংরা করা হয়েছে। আরও হলে ভালো হতো। মুন্ময়ী হাতের কাপটা টিভির কাছাকাছি ছুড়ে ফেলল। এখন চারদিকে ভাঙা কাচের টুকরা। চা। কিছু চা ছিটকে টিভি-পরদায়ও পড়েছে। বিস্তি ভীত-চোখে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী বলল, ঘর অগোছালো করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর মধ্যে এক ধরনের গোছানো ভাব আছে। বোঝাই যাচ্ছে ইচ্ছা করে ঘর অগোছালো করা হয়েছে। বুঝেছ?
কিছু না বুঝেই বিন্তি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
মূর্ণায়ী বলল, একটা বালিশ ছিঁড়ে বালিশের তুলা চারদিকে ছিটিয়ে দাও। আর কালো মলাটের ঐ মোটা বইটা আন। সবগুলো পাতা কুচিকুচি করে ছিড়বে। চার দিকে ছড়িয়ে দেবে।
আপা বই ছিড়া ঠিক না।
আমাকে উপদেশ দিতে হবে না। বই ঘেঁড়া খুবই ঠিক আছে। পৃথিবীতে এমন অনেক বই আছে যেগুলি শুধু যে ছিড়তে হয় তা না, ছিঁড়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হয়। বুঝেছ?
জি।
এখনও তুমি বুঝতে পারি নি। আমি এ রকম একটা বই কোনো-একদিন তোমাকে দেখাব। পাতায় পাতায় নোংরা ছবি। এখন কাজে লেগে পড়। বালিশের তুলা উড়াবে এবং বই ছিড়বে।
বিন্তির খুব ইচ্ছা করছে আপাকে জিজ্ঞেস করতে এই কাজগুলি কেন করা হচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল না। সে আবছাভাবে ধারণা করল অতি বড়লোকদের অনেক বিচিত্র খেয়াল থাকে। এইটাও সে রকম কিছু।
মৃন্ময়ী রকিং-চেয়ারে দোল খেতে খেতে টেলিফোনে কথা বলছে। সে তার গলার স্বর অনেক খানি বদলেছে। যে-কেউ মৃন্ময়ীর গলা শুনে ভাববে মৃন্ময়ী ভয়ংকর সুস্থতার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস কষ্টের অভিনয় করা তার জন্যে তেমন কঠিন কিছু না। মাকে সে দেখছে। মাসে একবার তার শ্বাস কষ্ট হবেই।
ছন্দা ভালো আছিস?
হুঁ।
কী করছিস?
পড়ছি। পরশু পরীক্ষা না!
ও আচ্ছা! পরশু পরীক্ষা।
ছন্দা বলল, তুই এমনভাবে কথা বলছিস কেন? তোর কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে।
ছন্দা আমি মারা যাচ্ছি।
কী বললি?
মৃন্ময়ী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কিছু না। Nothing.
এ রকম করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেন?
মৃন্ময়ী টেলিফোন রেখে দিল।
অভিনয় যতটুক করা হয়েছে তাতে ছন্দার খবর হয়ে যাওয়ার কথা। সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসবে। তবে সময় লাগবে। ঝিকাতলা থেকে বারিধারা। খুব কম করে হলেও চল্লিশ মিনিট। নাটকটা ঠিকমতো সাজানোর জন্যে চল্লিশ মিনিট অনেক সময়। তাকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে মার কাছ থেকে ঘুমের অষুধ এনে রাখতে হবে। একটা দুটা না, এক গাদা। এ ছাড়া নাটক জমবে না।
বিন্তি!
বিন্তি কাগজ ছিড়তে ছিড়তে বলল, জি আপা! তাকে খালাম্মা বলে দিয়েছেন মৃন্ময়ী যতবার ডাকবে ততবার বিন্তিকে বলতে হবে– জি আপামণি। বার বার ভুল হচ্ছে। ভাগ্যিস খালাম্মার সামনে এখনও হয় নাই।
কাগজ ছেঁড়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখ। আমার জন্যে কড়া এক কাপ কফি বানিয়ে আন।
বিন্তি উঠে দাঁড়াতেই মৃন্ময়ী বলল, তুমি কি পড়াশোনা জান?
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা খারাপ কিছু না। Fire and smoke এর বাংলা কী বল।
ধোঁয়া আর আগুন।
আমি বলেছি Fire and smoke, প্রথমে Fire তারপর Smoke, তুমি ধোঁয়া আগে কেন বললে?
ভুল হয়েছে আপামণি। কথার টানে বলেছি। আর বলব না।
ভাই-বোন কত জন?
দুই বোন, ভাই নাই।
ভাই নাই কেন?
বিন্তি মনে-মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, ভাই নাই কেন এই প্রশ্নের সে কী। জবাব দেবে? আপা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন জবাবটা শুনতেই হবে।
ক্লাস নাইনের পর আর পড় নি কেন?
বাপজান আলাদা সংসার করল। আমরা দুই ভইনের নিয়া মা পড়ল বিপদে।
ভইন কী? বল বোন। আবার বল।
আবার কী বলব আপামণি?
একটু আগে যেটা বলছিলে সেটা।
বিন্তি হতাশ ভঙ্গিতে বলল, বাপজান আলাদা সংসার করল। মা দুই মেয়েরে নিয়া পড়ল মহা বিপদে।
মৃন্ময়ী বলল, বাপজান আলাদা সংসার করল। তার মানে কি আরেকটা বিয়ে করল।
জি।
তোমার সৎমার নাম কী?
চিন্নাই বিবি।
তোমার বোনের নাম কী?
মিন্তি।
তোমার নাম বিন্তি। তোমার বোনের নাম মিন্তি?
আমরার গেরাম দেশের নিয়ম মিল দিয়া নাম রাখা।
শুদ্ধ করে কথা বল, গেরাম না গ্রাম।
বিন্তি বলল, গ্রাম।
তোমার মায়ের নাম কী?
শাহেরা।
তোমার বেতন কত?
আমি জানি না আপা। ম্যানেজার সাহেব বলেছেন উনি সব বিবেচনা করে নির্ধারণ করবেন।
তোমার বেতন যা-ই নির্ধারণ হোক প্রতিমাসের এই তারিখে তুমি আমার কাছ থেকে বখশিশ পাবে। এই বখশিশ হিসাবের বাইরে। খুশি হয়েছ?
জি আপা।
খুশি হলে মুখে হাসি নাই কেন? হাস। সুন্দর করে হাসবে। তারপর কফি বানাতে যাবে।
বিন্তির হাসি আসছে না। হাসো বললেই কি হাসা যায়? তার ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে মৃন্ময়ী নামের পরীর চেয়ে এক হাজার গুণ রূপবতী মেয়েটার মাথার ঠিক নাই। মাথা-খারাপ মানুষের বিশ্বাস নাই। তারা এই ভালো, এই মন্দ।
কী হল? এখনও খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছ, হাসছ না কেন?
বিন্তি হাসার চেষ্টা করল।
মৃন্ময়ী বলল, গুদ্র। হাসি সুন্দর হয়েছে। আরও সুন্দর হতে হবে। ঠিকমতো হাসতে পারা মস্ত বড় গুণ। মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াল। তাকে মার কাছে থেকে ঘুমের ওষুধ নিতে হবে।