মৃন্ময়ী বলল, তুমি যতটুক বুঝেছ ততটুক বল।
শায়লা বললেন, কোর্ট একটা অর্ডার দিয়েছে। কোর্টের সিদ্ধান্ত হলো তোর দাদাজান মানসিকভাবে সুস্থ না। তিনি তাঁর বিরাট সম্রাজ্যের বিলিব্যবস্থা করতে অক্ষম। কাজেই উনার সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব এখন তোর বাবার।
মৃন্ময়ী বলল, কোর্ট কি দাদাজানের সঙ্গে কথা বলেছে?
শায়লা বললেন, তুই আমার সঙ্গে চিৎকার করছিস কেন? আমি তো কোর্ট?
আমি চিৎকার করছি না। তোমরা একজনকে পাগল বানিয়ে ফেললে?
শায়লা বললেন, যে তোর বাবাকে পাতার পর পাতা গাধা লিখে পাঠায় সে পাগল না? তোর বাবা গাধা?
দাদাজানের কাছে গাধা। একজন বাবার কাছে তার অতি বুদ্ধিমান পুত্রও গাধা হতে পারে।
শায়লা বললেন, তোর সঙ্গে তর্ক করব না। যে মানুষ চেনে না জানে না এমন এক কাজের মেয়েকে বারিধারার চারতলা বাড়ি লিখে দেয় সে গাধা না?
মৃন্ময়ী বলল, কাজের মেয়েকে না দিয়ে তিনি যদি কোনো ইউনিভার্সিটিকে লিখে দিতেন তাহলেও কি তাকে গাধা বলতে? না কি তখন তিনি আরেকটু উন্নত ঘোড়া বলতে?
শায়েলা বললেন, তুই রেগে যাচ্ছিস। মানুষটার কাজকর্ম একটু চিন্তা করে দেখ, দিন-রাত নেংটি পরে বসে থাকে।
উনি উনার নিজের জায়গায় নেংটি পরে থাকেন। নেংটি পরে তোমাদের
কাছে আসেন না। মহাত্মা গান্ধীও কিন্তু নেংটি পরেই ঘুরতেন।
মৃন্ময়ী তুই আমার সামনে থেকে যা। আমি তোর দাদাজানকে পাগল বলি নি। কোর্ট বলেছে। ডাক্তাররা সার্টিফিকেট দিয়েছেন। নিউরোলজিস্টরা রিপোর্ট দিয়েছেন। যে নিউরোলজিস্ট তার চিকিৎসা করছেন তাঁর রিপোর্ট আছে। প্রফেসর সালাম। তুই প্রফেসর সালামের সঙ্গে কথা বল।
মৃন্ময়ী মায়ের সামনে থেকে উঠে গেল। তার অস্থির লাগছে। বাবার সঙ্গে এক্ষুনি সে কঠিন যুদ্ধে যাবে, না কি নিজেকে খানিকটা সামলে নেবে এটা বুঝতে পারছে না। সে প্রচণ্ড রেগেছে। এত রেগে থাকলে লজিক এলোমেলো হয়ে যায়। বাবা শান্ত লাজিকের মানুষ। মৃন্ময়ী দেরি করল না। চারতলায় উঠা শুরু করল। রান্নাঘর থেকে আরেক কাপ গরম কফি নিয়ে নিল। নিজের নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার জন্যে তার কফির গন্ধ দরকার।
শাহেদুর রহমান বই পড়ছিলেন। মেয়েকে দেখে হাত থেকে বই নামিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো বিবি।
মৃন্ময়ী বলল, জ্ঞানচর্চা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা যায়?
শাহেদুর রহমান, বললেন, জ্ঞানচর্চা বন্ধ রাখা অন্যায়, তবে আমার BB-র জন্য বন্ধ করা হলো। মা! বেগে আছ কেন?
মৃন্ময়ী বলল, বাবা! দাদাজান কেমন মানুষ?
শাহেদুর রহমান বললেন, অতি জটিল প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষই একেক জনের কাছে একেক রকম। তোমার দাদাজান তোমার কাছে এক রকম, আমার কাছে আরেক রকম। আবার কাজের মেয়ে বিন্তির কাছে অন্যরকম।
তোমার কাছে কেমন?
আমার কাছে উনি ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ। প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি, জানার প্রচণ্ড আগ্রহ। ক্লাস এইটে পড়া বিদ্যা নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। টাকা রোজগারের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনার দিকে নজর দিলেন। টিচার রেখে অবসর সময়ে পড়েছেন। আমি দিনরাত পড়ি, এই জিনিসটা উনার কাছ থেকে পেয়েছি।
এই মানুষকে তুমি পাগল ডিক্লেয়ার করছ?
শাহেদুর রহমান বললেন, সামান্য ভুল হলো মা। উনি নিজেই নিজেকে পাগল ডিক্লেয়ার করেছেন। তিনি যে দানপত্র করেছেন তার কপি আমার কাছে আছে, পড়লেই বুঝবে। পড়তে চাও?
না।
একটা কথা বলি— তিনি বেশ বড় অংকের টাকা রেখেছেন ঢাকা শহরকে ভিক্ষুক মুক্ত করার পরিকল্পনার জন্যে। তার প্রস্তাব ঢাকা শহরের সব ভিক্ষুককে ধরে বড় একটা জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরের কোনো নির্জন দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসা হবে। আর খোঁজখবর নেয়া যাবে না। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। প্রতি বছর জাহাজ যাবে। সব খরচ তোমার দাদাজানের। ঢাকা ভিখিরি মুক্ত হবার পর অন্যান্য বড় শহর একে একে ধরা হবে।
উইলে এরকম আছে না কি?
হ্যাঁ আছে। আমাকে উনি গাধা ভাবেন, অকর্মণ্য অলস ভাবেন তাতে কিছু যায়-আসে না। আমাকে গাধা-অকর্মণ্য-অলস উনি বানিয়ে রেখেছেন। তাঁর লক্ষ্য একটাই— আমি যেন কিছু করতে না পারি। গুলশানের জমি কিনলাম খুব আগ্রহ নিয়ে, একটা কাজ শুরু করব। কোর্ট ইনজাংশান দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিল। তার পেছনে কে? তোমার দাদাজান। উনাকে জিজ্ঞেস করলেই জানবে।
মৃন্ময়ী বলল, তিনি তোমাকে দেখতে পারেন না কেন?
একটা কারণ এই হতে পারে যে, আমি বাবার আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ বের করার চেষ্টা করেছি। যাদের পেয়েছি চাকরি দেবার চেষ্টা করেছি। তোমার দাদাজান এটা একেবারেই পছন্দ করেন নি। ফরিদ ছেলেটার কথাই ধর। তোমার দাদাজানের আপন ভাইয়ের ছেলের ছেলে।
এই ছেলে এটা জানে?
জানে না। না জানাই ভালো।
মৃন্ময়ী উঠে দাড়াল। শাহেদুর রহমান বললেন, মা রাগটা কি সামান্য কমেছে?
মৃন্ময়ী জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। শাহেদুর রহমান ডাকলেন ফরিদ। ফরিদ ঘরে ঢুকল। শাহেদুর রহমান বললেন, তাশের নম্বরগুলি যোগ করে দেখেছ কত হয়?
৩৬৪ হয় স্যার! ৩৬৫ হয় না।
তাশের প্রতিটি প্যাকেটে একটা জোকার থাকে। জোকারের নাম্বার এক। ঐ একও যোগ করতে হবে।
জি আচ্ছা স্যার!
মৃন্ময়ী তার কফির মগ ফেলে গেছে। মগটা দিয়ে আসো।
ফরিদ মগ নিয়ে বের হলো।
মৃন্ময়ীর ঘরের দরজা পুরোপুরি বন্ধ না, সামান্য খোলা। ফরিদ দরজায় টোকা দিল। ভীত গলায় বলল, ম্যাডাম! আমি ফরিদ। আপনার কফির মগ ফেলে এসেছিলেন।