মৃন্ময়ী বলল, দাদাজানের অতি ছেলেমানুষী শখের একটা হচ্ছে আমার কোনো একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হবে। তাকে নিয়ে আমি এই খামারবাড়িতে আসব। দুজনে হাসল, গল্প করব–তিনি দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে মজা পাবেন। এখন আমি যদি আপনাকে নিয়ে পুকুর ঘাটে যাই, কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনো একটা গাছের আড়ালে দাদাজানকে দেখা যাবে। তার হাতে থাকবে বাইনাকুলার। বাইনাকুলার দিয়ে তিনি দেখার চেষ্টা করবেন, আমরা কী করছি। আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে পুকুর ঘাটে?
আপনি আদেশ করলে যাব।
আচ্ছা যান আদেশ করছি। আসুন আমার সঙ্গে।
অনেকক্ষণ হলো দুজন পুকুরঘাটে। আশেপাশে কোথাও আলিমুর রহমানকে দেখা যাচ্ছে না। মৃন্ময়ী হাসতে হাসতে বলল, দাদাজানের এত সময় লাগছে। কেন কে জানে? মনে হয় বাইনাকুলার খুঁজে পাচ্ছেন না।
জহির হেসে ফেলল। মৃন্ময়ী বলল, এই প্রথম আপনাকে আমি হাসতে দেখলাম। দাদাজান যখন ভেংচি কাটছিল তখনও আপনি হাসেন নি। আপনার হাসি সুন্দর! আপনি ঘনঘন হাসবেন। মনে থাকবে?
থাকবে।
এইবার দাদাজানকে দেখা যাচেছ। কাঠালগাছের পেছন থেকে উকিঝুকি দিচ্ছেন। বলেছিলাম না হাতে বাইনাকুলার থাকবে! হাতে বাইনাকুলার!
শাহেদুর রহমানের সামনে ফরিদ
শাহেদুর রহমানের সামনে ফরিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সংসার। চালানোর কিছু টাকা আজ লাগবেই। বাজার হবে না এমন অবস্থা। স্যারকে ব্যাপারটা যেভাবেই হোক বুঝিয়ে বলতে হবে। বুঝিয়ে বলাটা তার জন্যে কঠিন। সে কাউকেই বুঝিয়ে কিছু বলতে পারে না। মৃন্ময়ী ম্যাডামকেও সে বুঝিয়ে বলতে পারে নি যে রাত সাড়ে এগারোটার টেলিফোনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মৃন্ময়ী ম্যাডাম হয়ত ধরেই নিয়েছেন সে-ই টেলিফোন করে।
শাহেদুর রহমান ফরিদের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আমাকে কিছু বলতে এসেছ?
ফরিদ বলল, জি স্যার।
টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া সংসার অচল। এই তো বলবে?
জি স্যার!
সামনের চেয়ারটায় বোস।
স্যারের সামনে বসে ফরিদের অভ্যাস নেই। সে জড়সড় হয়ে বসল। তার মাথা আরও ঝুলে গেল।
শাহেদুর রহমান বললেন, ফরিদ তুমি তাশ খেল?
ফরিদ চমকে উঠে বলল, জি না স্যার!
তাশ চিন তো? না কি তাশও চেন না?
তাশ চিনি।
শাহেদুর রহমান হাসি হাসি মুখে বললেন, তাশ আছে দুই রঙের কালো। এবং লাল। কালো হলো রাতের প্রতীক, লাল হলো দিনের। বুঝেছ?
জি স্যার!
তাশ চার ধরনের স্পেড়, ক্লাভস, ডায়মন্ড এবং হার্ট। এই চার ধরন হচ্ছে চার ঋতুর প্রতীক— শীত, গ্রীষ্ম, শরত, হেমন্ত। বুঝেছ?
জি স্যার।
প্রতিটি গ্রুপে তাশ আছে তেরোটা করে। এই তেরো হলে লুনার সাইকেলের প্রতীক। বত্সরে লুনার সাইকেল আছে তেরোটা। ঠিক আছে?
জি স্যার!
এখন তুমি ভাশের নাম্বারগুলি যোগ কর। গোলাম এগারো, বিবি বারো, সাহেব তেরো। যদি যোগ কর তা হলে যোগফল হবে ৩৬৫, একটা বৎসরে দিনের সংখ্যা হলো ৩৬৫। পুরো ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াল?
ফরিদ কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। সংসার আটকে গেছে টাকার জন্যে, এখানে তাশের ভূমিকাটা কী?
শাহেদুর রহমান বললেন, চেক বই আন। এখন চেক ফেরত আসবে না। ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফরিদ পকেট থেকে চেক বই বের করল। শাহেদুর রহমান চেক বইয়ে দস্তখত করতে করতে বললেন, ব্যাংক থেকে টাকা আনার পথে এক প্যাকেট তাশ কিনে আনবে। গুনে দেখবে যোগ ফল ৩৬৫ হয় কি না।
জি আচ্ছা স্যার!
ফরিদের খুব ইচ্ছা করছে জানতে সমস্যার সমাধান কীভাবে হলো। বড় সাহেব কি ছেলেকে ক্ষমা করেছেন। ব্যাংকে টাকা জমা পড়েছে? ছোট মানুষের বড় বড় বিষয় জানতে চাওয়া উচিত না। কিন্তু ছোট মানুষরা তো হঠাৎ হঠাৎ অনুচিত কাজ করে ফেলে।
শাহেদুর রহমান বই হাতে তার পড়ার চেয়ারে বসলেন। তাঁর হাতে নতুন একটা বই Diseases Treated with Fruits, লেখকের নাম Xiu Zongchang. ফলমূল দিয়ে অসুখ সারানোর কৌশল জানা থাকা ভালো।
রাতকানা রোগ
ক. প্রতিদিন সকালে একটা করে গাজর দশ দিন ধরে যেতে হবে।
খ. পাঁচশ গ্রাম পালং শাক পিষে রস করে দিনে দুবার খেতে হবে। দশ দিন।
প্রতিটি অষুধই দশদিন ধরে খাওয়ার বিধান কেন এটা নিয়ে শাহেদুর রহমান চিন্তা করছেন। দশ দিনের হিসাবটা বুঝা যাচ্ছে না। লোকজ চিকিৎসা চন্দ্র হিসেবে করা হয়। দশ দিন কোনো হিসাবেই যায় না।
ব্যাংক থেকে টাকা পেতে ফরিদের সমস্যা হলো না। ইচ্ছা করলে সে ব্যাংক ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করতে পারত। জিজ্ঞেস করল না। তার টাকা তোলা দিয়ে কথা। সে টাকা তুলবে, এক প্যাকেট তাশ কিনে ঘরে ফিরবে। বসে বসে শুনবে। গুনে দেখবে ৩৬৫ হয়েছে। তার কাজ শেষ।
মৃন্ময়ী তার মার ঘরে। মৃন্ময়ীর হাতে কফির কাপ। কফিতে সে চুমুক দিচ্ছে না। কফির তিতকুটে স্বাদ তার ভালো লাগে না। তবে কফির গন্ধ ভালো লাগে। মগভর্তি কফি হাতে বসে থাকলে মাঝে মাঝে কফির গন্ধ পাওয়া যায়।
শায়লা আজ অনেক ভালো। তিনি তার ঘরের জানালা খুলে দিয়েছেন। ঘরে রোদ ঢুকেছে।
মৃন্ময়ী বলল, মা শুনলাম বাবার টাকাপয়সা সমস্যার নাকি সমাধান হয়ে গেছে।
জানি না।
মৃন্ময়ী বলল, জানবে না কেন? অবশ্যই জান। আমার তো ধারণী কলকাঠি তুমিই নেড়েছ।
শায়লা বললেন, তুই কি ঝগড়া করতে এসেছিস?
মৃন্ময়ী বলল, ঝগড়া না, আমি জানতে এসেছি।
শায়লা বললেন, তোর বাবা পাওয়ার অব এটর্নি পেয়েছে।
মানে কী?
এত কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না। আইনের সব কিছু আমি বুঝি না।