অবশ্যই দেয়া যাবে। আমার হাতে দিন। আমি দিয়ে আসছি। মৃন্ময়ী চিঠিতে লিখেছে–
ছন্দা,
আমার হিসাব যদি ঠিক হয়, তা হলে তুই সুখে আছিস। তুই অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। অতি বুদ্ধিমতীরা সুখ বের করে নিতে জানে। বোকা মেয়েগুলিই বেছে বেছে দুঃখ কুড়ায়। আমি তোকে খুব পছন্দ করি আবার তোর বাবাকেও খুব পছন্দ করি। অথচ দুইজন দুই মেরুর।
ভালো থাকিস।
ইতি
মৃন্ময়ী
পুনশ্চ # ১ : তোর একটা পেট্রেটা করার বলেছিলাম, মনে আছে? আর্টিস্ট ভদ্রলোক আগামীকাল থেকে ফ্রী। দাদার ছবি তিনি একে শেষ করেছেন। আজ হ্যান্ডওভার করবেন। আমি ছবি হ্যান্ডওভারের দৃশ্য দেখতে যাচ্ছি। দাদাজানের ছবি যদি পছন্দ হয় তবেই তোর ছবি আঁকানো হবে। তৈরি হয়ে থাক।
পুনশ্চ # ২ : তোর যে একটা মানসিক রোগ আছে, শুনেছি বিয়ের পর এই রোগ সেরে যায়। স্বামীর ভালোবাসা এই রোগের একমাত্র ওষুধ। মনে রাখিস।
জহির মৃন্ময়ীর হাতে ছবি দিল
জহির মৃন্ময়ীর হাতে ছবি দিল। মৃন্ময়ী অনেক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে যেমন আঁকতে বলা হয়েছিল আপনি সে রকম আঁকতে পারেন নি। আপনাকে বলা হয়েছিল কঠিন চোখে দাদাজান তাকিয়ে আছেন— এমন ছবি আঁকবেন। আপনি দুনিয়ার মমতা দাদাজানের চোখে দিয়ে দিয়েছেন। এই ছবি আমি বাবাকে দিতে দেব না। এটা আমি রেখে দেব। দরকার হলে আপনি আরেকটা আঁকবেন।
আলিমুর রহমান ছবি হাতে নিয়ে বললেন, জহির চোখের কোনায় কি পানি?
জহির বলল, জি স্যার! আপনি আপনার মায়ের কথা বলছিলেন। তখন আপনার চোখ ভিজে উঠেছিল। ঐটা আমার মাথার ভিতর ঢুকে গিয়েছিল।
মৃন্ময়ী বলল, আর্টিস্ট সাহেব। ছবির দিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে আমার তরফ থেকে সামান্য উপহার দিতে চাই। বলুন কোন উপহার পেলে আপনি খুশি হবেন? তাড়াতাড়ি বলতে হবে। এক থেকে তিন গুনার মধ্যে বলবেন। এক… দুই…
জহির বলল, আমার এক বন্ধু আছে। তার নাম ফজলু। ওয়াটার কালারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল। আমি তার কাছে কিছু না। আমার বন্ধুটা মরতে বসেছে। ডাক্তররা বলেছেন বাইরে নিয়ে শেষ চেষ্টা করতে। আমি যাতে সেই শেষ চেষ্টাটা করতে পারি তার ব্যবস্থা করে দিন।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান ব্যবস্থা করে দেবেন। আপনি এই নিয়ে আর চিন্তাই করবেন না।
জহির বলল, থ্যাংক য়্যু।
আলিমুর রহমান বললেন, জহির তোমার একটা সস্তা সিগারেট দাও তো খাই। শোন জহির! আমি মুখ ভেংচি দিয়ে আছি, এ-রকম একটা ছবি একে দাও। আমি আমার গাধাপুত্রকে উপহার দেব।
জহির হাসলো।
আলিমুর রহমান বললেন, হাসি না, এখনই আঁকা শুরু কর। ভেংচি-মুখ আঁকবে। তোমার রঙের বাক্স নিয়ে আস।
মৃন্ময়ী বলল, আজকের দিনটা বাদ থাকুক। কাল থেকে আঁকা হবে।
আলিমুর রহমান বললেন, আজই। আজ আমার ভেংচি দিতে ইচ্ছা করছে। কাল হয়ত করবে না। মুন্ময়ী দেখ তো, কোন ভেংচিটা ভয়ঙ্কর?
আলিমুর রহমান ভেংচির কয়েকটা নমুনা দেখালেন। মৃন্ময়ী খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল।
মৃন্ময়ী বলল, আর্টিস্ট সাহেব এই দেখুন আমার চোখে পানি। ভালো করে দেখে রাখুন। যদি কখনও আমার ছবি আঁকেন চোখের কোণে পানি দিতে ভুলবেন না।
জহিরকে ব্রাশ, রঙ নিয়ে বসতে হলো। তার কাছে মানুষটার কাণ্ডকারখানা অদ্ভুত লাগছে। তিনি সত্যি সত্যি মুখ ভেংচি দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। মৃন্ময়ী একা একা বাগানে হটছে।
জহির বলল, স্যার আপনাকে সিটিং দিতে হবে না, আপনার চেহারা আমার মাথায় আছে। আপনি আপনার নাতনীর সঙ্গে গল্প করুন। বেচারী একা একা হাঁটছে।
আলিমুর রহমান বললেন, আমার নাতনী যে তোমাকে খুব পছন্দ করে এটা টের পেয়েছ?
আমার আঁকা ছবি উনার পছন্দ হয়েছে এইটুকু বুঝতে পেরেছি।
আমার নাতনীকে তোমার কেমন লাগে? সে কী টাইপের মেয়ে?
জহির বলল, আপনার মতো। আপনার সঙ্গে সাংঘাতিক মিল।
আলিমুর রহমান বললেন, আমার সঙ্গে কী মিল দেখলে?
জহির বলল, আপনার মতো পাগলাটে স্বভাব।
তোমার স্বভাব কেমন?
আমার মধ্যে পাগলামী নেই, আমার বন্ধু ফজলুর মধ্যে আছে। আর্ট কলেজে পড়বার সময় সে একবার ঠিক করল কলেজের বাইরের সময়টায় সে ভিক্ষা করবে। পুরোপুরি ভিক্ষুক।
আলিমুর রহমান আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ভিক্ষা করেছে?
জহির বলল, তিন মাসের মতো করেছে। একদিন প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্যার গাড়ি করে ফিরছেন। সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। ফজল গেছে ভিক্ষা চাইতে।
আলিমুর রহমান বললেন, এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প! এ-রকম গল্প কি তোমার স্টকে আরও আছে?
জি আছে।
আলিমুর রহমান বললেন, একটা কাজ কর, এই গল্পটা মৃন্ময়ীকে শুনিয়ে আস। এক্ষুনি যাও। গল্প শুনে তার রিএকশন কেমন হয় আমি দূর থেকে দেখব।
জহির সিগারেট ধরাল। তার ইচ্ছা করছে এই বুড়োকে কিছু কঠিন কথা শুনাতে। জীবনটা সিনেমা না এবং এই বৃদ্ধ স্ক্রিপ্ট রাইটার না। তার স্ক্রিপ্ট মতো একটা ছেলে যাবে এবং তার আদরের নাতনীর সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করবে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে তিনি আহাদ পাবেন।
আলিমুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কী হলো যাচ্ছ না কেন?
জহির রওনা হলো। মৃন্ময়ীর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান আপনাকে পাঠিয়েছেন, তাই না?
জহির বলল, জি।
মৃন্ময়ী বলল, কী বলতে হবে, তাও কি বলে দিয়েছেন?
জহির বলল, না।