আলিমুর রহমান মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার কথা শুনছেন। কী গুছিয়েই না এই
মেয়ে অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছে!
আলিমুর রহমান বললেন, তোমার স্বামী মাছ মারে তুমি পাশে বসে থেকে কী কর?
কী আর করব! কখনও কুরশি কাটা দিয়ে সেলাই করি আবার কখনও গানটান গাই।
তুমি গনি জান না-কি?
রেডিও-টিভি থেকে শুনে শুনে শিখেছি। টুনটুনির বাবা অবশ্য অনেকবার বলেছে গানের টিচার রেখে দেই। গান শেখ। আমি বলেছি, না।
না বললে কেন?
আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব ইসলামিক মাইন্ডেট। গান-বাজনা পছন্দ করেন না। আপনি কি আমার একটা গান শুনবেন?
অবশ্যই শুনব।
সিনেমার গান। সিনেমা থেকে শিখেছি।
মীনা গান ধরল—একটা ছিল সোনার কন্যা।
ম্যানেজার কালাম ক্যামেরা নিয়ে এসে অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে দাড়াল। বড় সাহেবের কোলে টুনটুনি নামের মেয়েটা বসে আছে। মেয়েটার মা সামনে বসে গান গাইছে।
আলিমুর রহমান তাঁর লইয়ারকে নিয়ে বসেছেন। তিনি উইলে আরো কিছু পরিবর্তন করবেন। মীনা এবং টুনটুনির জন্য এমন কিছু ব্যবস্থা করবেন যেন বাকি জীবন তারা নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারে।
উকিল বললেন, দানপত্র করাই ভালো। দানপত্রে লিখতে হবে যে মেয়েটার সেবায় তুষ্ট হইয়া তাহাকে দান করিলাম।
আলিমুর রহমান বললেন, সেবায় তুষ্ট হই নাই। তার মিথ্যা কথা শুনে তুষ্ট হয়েছি। যদি লেখা হয় তাহার মিথ্যা কথা শুনিয়া তুষ্ট হইয়া অমুক অমুক জিনিস দান করিয়াছি। তাতে অসুবিধা আছে?
উকিল তাকিয়ে রইল।
আলিমুর রহমান বললেন, আমার তুষ্ট হওয়া দিয়ে কথা। তুষ্ট কীভাবে হয়েছি সেটা বিষয় না। তুমি কাগজপত্র তৈরি কর।
আপনি আপনার ছেলেকে সত্যি কিছু দেবেন না?
না।
কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
আলিমুর রহমান বললেন, তোমাকে টাকা দিয়ে আমি এনেছি আমার কাজের সমালোচনার জন্য না। আমার কাজ করে দেবার জন্য।
ইয়াকুব আলি সকাল আটটা থেকে
ইয়াকুব আলি সকাল আটটা থেকে মৃন্ময়ীদের বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তাঁর চেহারায় দিশাহারা ভাব। বাড়িতে ঢুকে তিনি বেশ হকচকিয়ে গেছেন। মৃন্ময়ী মেয়েটা বড়লোকের মেয়ে এটা তিনি জানেন কিন্তু সে যে এমন একটা
বিশাল ড্রয়িং রুমের এক কোনায় তিনি হতাশ হয়ে বসে আছেন। ম্যানেজার জাতীয় একটা ছেলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ছেলেটা বলেছে, মৃন্ময়ী আপা তার ঘরেই আছেন। হাঁটাহাটি করছেন, গান শুনছেন। তবে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, কাজেই এখন দরজায় টোকা দেয়া যাবে না।
ইয়াকুব বললেন, দরজা বন্ধ থাকলেই না লোকজন বাইরে থেকে টোকা দেবে। দরজা খোলা থাকলে দিবে কেন?
এই বাড়ির এ-রকমই নিয়ম। আপনি বলুন আপা দরজা খুললেই তাকে খবর দেয়া হবে। আপা কি আপনাকে চেনেন?
আমার মেয়ে তার সঙ্গে পড়ে। আমার নাম ইয়াকুব আলি।
ইয়াকুব একবার ভাবলেন বলবেন আমার মেয়ের নাম ছন্দা। শেষপর্যন্ত বললেন না। এমনও হতে পারে ছন্দা পালিয়ে এ-বাড়িতেই বসে আছে। এখন হয়ত গল্প করছে মৃন্ময়ীর সঙ্গে।
গতকাল সকালে তিনি ছন্দাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। কঠিন গলায় বলেছেন, বাকি জীবন আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।
ছন্দা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, বাবা আমি যাব কোথায়?
তিনি বলেছেন, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবি। আমার এখানে না। আমি চোর-মেয়ে ঘরে রাখব না।
ঘটনা ঘটেছে সকাল নয়টায়। বারো ঘণ্টা পর রাত নয়টার দিকে তিনি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবখানে। মৃন্ময়ীকে টেলিফোন করেছেন কিছুক্ষণ পর পর। যতবারই টেলিফোন করেন ততবারই শোনা যায়—এখন সংযোগ দেয়া সম্ভব না। আবার ডায়াল করুন।
মৃন্ময়ীর বাসার ঠিকানা বের করতেও তাঁর খুব ঝামেলা হয়েছে। কেউ ঠিকানা বলতে পারে না।
আপনি কি চা খাবেন? চা দিতে বলি?
ম্যানেজার ছেলেটা আবার এসেছে। ইয়াকুব আলি বললেন, দরজা কি খুলেছে?
জি-না এখনও না। আপনাকে চা দিতে বলি?
না। এক গ্লাস পানি দিতে পারেন।
টেবিলের নিচে খবরের কাগজ আছে। ইচ্ছা করলে খবরের কাগজ পড়তে পারেন।
আমার কিছু লাগবে না। একটু তাড়াতাড়ি যদি খবরটা দেয়া যায়। বিশেষ ঝামেলায় আছি।
দরজা খুললেই খবর দেব।
ইয়াকুব বুঝতে পারছেন না ঝামেলার ব্যাপারটা মৃন্ময়ীকে খোলাখুলি বলবেন কি-না। বলা অবশ্যই উচিত কিন্তু বলবেন কীভাবে? সবকিছু কি বলা যায়?
ঘটনাটা এ রকম— সকালে নাশতা খেয়ে তিনি চায়ের কাপ নিয়ে ইজিচেয়ারে বসেছেন, হুড়মুড় করে তিনটা মেয়ে ঢুকে পড়ল। তিনি যে বসে আছেন সে-দিকে ফিরেও তাকালো না। ঢুকে গেল ছন্দার ঘরে। বিছানা বালিশ উল্টাচ্ছে, ড্রয়ার খুলছে, আলমিরা খুলছে। তিনি বললেন, এইসব কী? মেয়ে তিনটার একটা বলল, ছন্দা তার গয়না চুরি করেছে। দুই ভরি ওজনের একটা গলার চেইন।
ইয়াকুব বললেন, তোমরা কি পাগল হয়ে গেলে? আমার মেয়ে করবে চুরি? আমার মেয়ে?
আর তখনই অন্য একটা মেয়ে বলল, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। মেয়েটার হাতে চেইন। তারা যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল, সে-রকম ঝড়ের মতো চলে গেল। তিনি দেখলেন, ছন্দা ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। তিনি বললেন, ছন্দা তুই কি চেইনটা চুরি করে এনেছিলি?
ছন্দা জবাব দিল না।
মৃন্ময়ী এসেছে। ইয়াকুব আলিকে দেখে সে মোটেই চমকালো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, চাচা স্লমালিকুম। আপনি এসেছেন? কেমন আছেন চাচা।
ইয়াকুব আলি বললেন, মাগো! আমি ভালো নাই। আমি খুব খারাপ আছি।