জহির উঠে পড়ল। বাস ধরে সাভার যেতে হবে। আলিমুর রহমান সাহেব যদিও বলে দিয়েছিলেন, ম্যানেজারকে বললেই ম্যানেজার গাড়ি পাঠাবে। কী দরকার? মানুষের কাছ থেকে উপকার নিতে হয় না, উপকার করতেও হয় না।
সেই আগের দৃশ্য।
আলিমুর রহমান পা তুলে চেয়ারে বসে আছেন। জহির ব্রাশ ঘষছে। জহিরের ঠোঁটে সিগারেট।
আলিমুর রহমান বললেন, ছবি কী আজ শেষ হবে?
জহির বলল, না।
কবে শেষ হবে?
জানি না।
ঠিক আছে তাড়াহুড়া নাই। আঁকতে থাক। মীনা ভালো আছে? তোমার বোন মীনা।
জি স্যার! ভালো আছে।
তোমার বোনের যে মেয়ে সে ভালো আছে?
জি ভালো আছে।
তার নাম কী?
তার নাম টুনটুনি।
জহির একটা কাজ কর। একদিন মীনা আর টুনটুনিকে এখানে নিয়ে এসো।
এটা ভালো হবে না স্যার।
ভালো হবে না কেন?
আমার বোন অংহ্লাদী ধরনের মেয়ে। আপনার সঙ্গে নানান আহ্লাদী করবে। আপনি রেগে যাবেন।
রেগে যাব কেন?
ওর আহ্লাদী সহ্য করার মতো না।
আলিমুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, একটা উদাহরণ দাও তো।
উদাহরণ মনে আসছে না স্যার। তবে সে যে কোনো মানুষকে আহ্লাদী করে অতি দ্রুত রাগিয়ে দিতে পারে।
আলিমুর রহমান গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, কালাম! কালাম!
ছবি আঁকার সময় কালাম বড় সাহেবের দৃষ্টির বাইরে থাকে, তবে সারাক্ষণ কানখাড়া করে রাখে। যেন ডাক শোনামাত্র ছুটে আসতে পারে। কালাম এসে সামনে দাঁড়াল। আলিমুর রহমান বললেন, তুমি এক্ষুনি গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যাও। জহিরের বোন আর বোনের মেয়েকে নিয়ে আসবে। জহিরের কাছ থেকে একটা চিঠি লিখিয়ে নিয়ে যাও।
জহির ছবি আঁকা বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। আলিমুর রহমান হুকুমের গলায় বললেন, জহির তোমার বাসার ঠিকানা ম্যানেজারকে ভালো করে বুঝিয়ে দাও। অনেক দিন কোনো আহ্লাদী মেয়ে দেখি না। একটা দেখতে ইচ্ছা করছে।
আলিমুর রহমান সিগারেট ধরালেন। লম্বা লম্বা টান দিয়ে মুখ গোল করে ধোয়া ছাড়ছেন। তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে।
জহির।
জি স্যার!
আমার মহাজ্ঞানী পুত্র ছবি আঁকার জন্যে তোমাকে কত টাকা দেবে বলে ঠিক করেছে?
উনি কিছু বলেন নি।
তুমি কিছুই পাবে না।
সে তোমাকে এক টাকার একটা ময়লা ছেঁড়া নোটও দিবে না। কারণ তার ব্যাংকে টাকা নেই। আমি খবর নিয়েছি। তার মাথা এখন ফোটি নাইন। ফোটি নাইন শব্দের অর্থ জান?
জি জানি।
আমার পুত্রের মাথা এখন ফোটি নাইন। সাত গুণন সতি। হা হা হা। আচ্ছা জহির শোন তোমার আহ্লাদী বোন কী খেতে পছন্দ করে? তার পছন্দের সব খাবার বাবুর্চিকে রান্না করতে বলব।
মীনা চলে এসেছে এবং মেয়ে নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করছে। ম্যানেজার তাকে আলিমুর রহমানের কাছে নিয়ে গেল। মাঝখানে গলা নামিয়ে বলল, স্যারের সঙ্গে কোনো বেয়াদবী করবেন না।
মীনা বিরক্ত হয়ে বলল, বেয়াদবী কেন করব! আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয় আমি বেয়াদব মেয়ে?
এমি বললাম। আমাদের স্যার খুব রাগী মনি তো।
মীনা বলল, আমরাও খুব রাগী। আমাদের টাকাপয়সা আপনাদের চেয়ে কম এটা মানি। আমাদের রাগ কম এটা মানি না।
আলিমুর রহমান মাছ মারতে বসেছেন। মীনা তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। টুনটুনিকে দিয়েও করাল। টুনটুনিকে সে সালাম করা শিখিয়েছে।
আলিমুর রহমান বললেন, মেয়ে তো খুব সুন্দর!
মীনা বলল, ওর বাবার মতো হয়েছে। তবে ওর বাবার রঙ আরো ভালো। তাই না কি?
জি। সে আপনার চেয়েও ফর্সা। ঢাকায় থাকলে আপনাকে এনে দেখাতাম। সে আছে বিদেশে। মিডিল ইস্টে। বড় চাকরি করে।
ও আচ্ছা!
কোয়ার্টার পেয়েছে। চার রুমের বিরাট বাড়ি। সার্ভেন্টর জন্যে আলাদা ঘর। ওদের পেশাব-পায়খানার জন্য আলাদা বাথরুম। চিঠি লিখেছে আমাদের চলে যাবার জন্যে।
যাচ্ছ না কেন?
ভাইয়াকে একা ফেলে কীভাবে যাব বলেন? ভাইয়াকে কে দেখবে? আমরা দুই ভাই-বোন ছাড়া আর কেউ নাই। মা আমার জন্মের সময় মারা গেছেন। বাবা মারা গেছেন আমার যখন আট বছর বয়স। মা-বাবা না থাকার জন্যে আমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে মিল খুব বেশি। তাই ঠিক করেছি ভাইয়াকে বিয়ে দিয়ে তারপর যাব। তাকে একা ফেলে যাব না। এটা ভালো না?
হ্যাঁ ভালো।
ভাইবোনের মধ্যে আমাদের মতো মিল আপনি কোথাও দেখবেন না। আপনার সঙ্গে এই নিয়ে লক্ষ টাকা বাজি রাখতে পারি। এই যে দেখুন, আপনার এখানে ভাইয়া ছবি আঁকতে এসেছে, এটাই তো তার কাজ। এর মধ্যে জরুরি চিঠি দিয়ে আমাকে আনিয়েছে। টুনটুনিও ভাইয়ার চোখের মণি। বেশিক্ষণ টুনটুনিকে না দেখলে ভাইয়া থাকতে পারে না। টুনটুনিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে ভাইয়ার অবস্থা কী হবে চিন্তা করে আমার ঘুম হয় না।
আলিমুর রহমান বললেন, তুমি তো ভালো সমস্যাতেই আছ।
জি! বিরাট সমস্যায় আছি। আপনার এখানে ক্যামেরা আছে?
কেন বল তো?
নতুন জায়গায় এসেছি, কিছু ছবি তুলতাম। টিয়াকে পাঠাতাম। টুনটুনির বাবার নাম সবুজ। ও আমাকে ডাকে ময়না, আমি তাকে ডাকি টিয়া।
আলিমুর রহমান বললেন, তোমরা তা হলে পাখি বংশ? টুনটুনি, ময়না, টিয়া।
মীনা আনন্দিত গলায় বলল, জি! আমরা পাখি বংশ। টুনটুনির একটা ভাই যখন হবে তার নাম রাখব তিতির। তিতিরপাখির নাম আপনি শুনেছেন না?
শুনেছি।
তিতির নাম সুন্দর না?
হ্যাঁ সুন্দর।
আলিমুর রহমান ম্যানেজারকে পাঠালেন ক্যামেরা আনতে।
মীনা বলল, আপনার মাছ মারার শখ, তাই না?
হ্যাঁ।
টুনটুনির বাবারও মাছ মারার খুব শখ। ওদের নিজস্ব বিরাট পুকুর আছে। পুকুর ভর্তি মাছ। আপনি যেমন মাছ মারার জন্যে আলাদা ঘাটলা বানিয়েছেন ওদেরও সে-রকম আছে। ছুটির দিনে সকালে সে মাছ মারতে বসে। আমাকে সব কাজ ফেলে পাশে বসে থাকতে হয়। কাজ-কর্মের অবশ্য কোনো অসুবিধা হয় না। ওদের অনেকলি কাজের লোক।