ইয়াকুব বললেন, মা তুমি যখন দায়িত্ব নিয়েছ তখন আমার কোনো কথা নাই।
বিন্তি রাতের শেষ চা নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী বলল, চা খাব না।
বিন্তি বলল, আপনার চুলে তেল দিয়ে দিব আপা?
মৃন্ময়ী বলল, না। আমি চুলে তেল দেই না।
একদিন দিয়া দেখেন খুব আরাম পাইবেন।
খুব আরামের কি দরকার আছে?
অবশ্যই আছে। আরামের জন্যই তো দুনিয়া।
মৃন্ময়ী বলল, যাও তেল নিয়ে আসো। দেখি কী রকম আরাম!
ঘরের বাতি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা টেবিল ল্যাম্প ছাড়া সব বাতি নেভানো। মৃন্ময়ী বিছানায় শুয়ে আছে। বিন্তি চুলে তেল দিয়ে চুল টেনে দিচ্ছে।
বিন্তি বলল, আপা একটা গফ শুনবেন?
মৃন্ময়ী বলল, গফ না গল্প। যদি ভাষা শুদ্ধ করে বলতে পার তা হলে শুনব।
বিন্তি বলল, আমার গ্রামে আপনের মতো সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। বারো–তেরো বছর বয়স হইতেই এই মেয়ের জন্য ভালো ভালো সম্বন্ধ আসা শুরু হইল। এর মধ্যে একজনের সঙ্গে বিবাহ ঠিক হয়ে গেল। তখন মেয়েটারে ধরল জিনে।
জিনে ধরল মানে কী?
সুন্দরী মেয়েদের জীনে ধরে। তারার শরীরে জীনের ভর হয়।
আমিও তো সুন্দর। আমার সঙ্গে জীন আছে?
বিন্তি বলল, অবশ্যই আছে। আপনে যে উল্টা-পাল্টা কাজ-কাম করেন জিনের কারণে করেন।
উল্টা-পাল্টা কাজ কী করলাম?
আপনের নাক ফুল দিয়া কী করলেন আপনার মনে নাই?
মৃন্ময়ীর টেলিফোন বেজে উঠেছে। সে ঘড়ি দেখল। সাড়ে এগারোটা বাজে। মৃন্ময়ী টেলিফোন কানে নিয়ে দুবার হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে লাইন কেটে দিল।
মীনা বলল, ভাইয়া তুমি কি দুপুরে খাবে
মীনা বলল, ভাইয়া তুমি কি দুপুরে খাবে?
জহির বলল, না।
রাতে কখন ফিরবে? দেরি হবে?
দশটার মধ্যে ফিরব।
মীনা বলল, ভাইয়া একটা ফ্রিজ কিনতে পার না। ফ্রিজ থাকলে খাবার নষ্ট হতো না। গরমের সময় ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খেতে কত ভালো লাগে।
জহির কিছু বলল না। মীনার অতি স্বাভাবিক আচরণ মাঝে মাঝে তার কাছে বিস্ময়কর লাগে। সবুজের প্রসঙ্গ একবারও সে তুলে না! যেন সবুজ নামের কেউ তার জীবনে আসে নি।
ভাইয়া টুনটুনি আজ কী করেছে শোন! আঙুল কেটে ফেলেছে। টুনটুনি মামাকে কাটা আঙুল দেখাও।
টুনটুনি ভয়ে-ভয়ে একটা আঙুল উঁচু করে দেখাল। মীনা বলল, এখন মামার কাছে নিয়ে যাও মামা আঙুলে উম্মা দিয়ে দিবে।
জহির বলল, উম্মা কী?
মীনা বলল, উম্মা হলো চুমু। টুনটুনি নিজে নিজে অনেক অদ্ভুত শব্দ বানিয়েছে। যেমন তুলতা। তুলতা শব্দটার মানে কী ভাইয়া আন্দাজ করতো।
আন্দাজ করতে পারছি না।
মীনা বলল, তুলতা হলো বিড়াল। দুটা শব্দের মধ্যে কোনো মিল আছে বল? কোথায় তুলতা আর কোথায় বিড়াল। টুনটুনি যাও মামার কাছে। মামা তোমাকে উম্মা দিবে। মামাকে ভয় পাও কেন? যাও যাও।
জহির বলল, জোর করে পাঠাতে হবে না। ভয় আস্তে আস্তে ভাঙাই ভালো। তোর বাজার-টাজার কিছু লাগবে?
মীনা বলল, বাজার আছে। ভাইয়া একটা টেলিভিন কিনে দাও না। সারদিন ঘরে থাকি। টেলিভিশন থাকলে সময় কাটত। কতদিন নাটক দেখি না।
জহির বের হয়ে গেল। প্রথমে গেল হাসপাতাল, ফজলুর সঙ্গে কিছু সময় কাটালো। সেখান থেকে সাভারে আলিমুর রহমান সাহেবের খামারবাড়ি। পোট্রেটের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে দু-একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
ফজলুর অবস্থা কয়েক দিনে আরো খারাপ হয়েছে। সে এখন একনাগারে বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকতে পারে না। আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তবে গলার স্বর এখনও সতেজ। সে পাশ ফিরে শুয়েছে। জহিরের দিকে তাকিয়ে আগ্রহের সঙ্গে গল্প করছে।
এক লোক লটারিতে জিতে ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছে। ফার্স্ট প্রাইজ হচ্ছে সারা পৃথিবী ভ্রমণের প্লেনের টিকিট। ফ্রী হোটেল। ফ্রী খাওয়া-দাওয়া। এত বড় লটারি জিতেও লোকটার মুখে হাসি নেই। একজন জিজ্ঞেস করল, কী হলো ভাই খুশি হন নাই? লোকটি মাথা চুলকে বলল, খুশি হয়েছি তবে অন্য কোথাও যেতে পারলে ভালো হতো।
প্রশ্নকর্তা বললেন, অন্য কোথাও মানে কী?
সেই লোক ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, মানে গ্রামের কোনো বাঁশবন। মেঠোপথ। এইসব আর কি…?
জহির বলল, এই গল্পের মানে কী?
ফজলু বলল, মানে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার গ্রামের বাঁশবন, মেঠোপথ এই সব দেখতে ইচ্ছা করছে। দশ বছরের বেশি হয়েছে গ্রাম দেখি না।
জহির বলল, শরীর ঠিক হোক গ্রাম দেখিয়ে আনব।
শরীর ঠিক হবে না। সস্তা দেশী মদ খেয়ে লিভার তো আগেই নষ্ট ছিল, এখন ধরেছে ভাইরাস বাবাজি। শক্ত জিনিস।
জহির বলল, তোর শরীর একটু সারলেই তোকে আমি আমার কাছে এনে রাখব। আমার বোন আছে সে যত্ন করবে।
ফজলু বলল, এই দফায় টিকে গেলে বাঁশবনের ছবি আঁকব। বাঁশবনের ভিতর দিয়ে রোদে এসে পড়েছে। শুধুই আলোছায়ার খেলা। লেমন ইয়োলো আর কোবাল্ট ব্লু। তোর পোট্রেট আঁকা কেমন চলছে?
ভালো।
কয়েকদিন থেকে কেন জানি ছবি আঁকতে ইচ্ছা করছে। ওয়াটার কালার। হালকা ওয়াসে দুই-একটা গাঢ় রঙের টান।
জহির বলল, কাগজ, রঙ দিয়ে যাব?
ফজলু বলল, পাগল হয়েছিস! জেনারেল ওয়ার্ডের এক মরণাপন্ন রোগী জীবনের শেষ ছবি আঁকছে। এই সব সিনেমায় সম্ভব, বাস্তবে সম্ভব না। তুই এখন চলে যা। কতক্ষণ আর রোগীর পাশে বসে থাকবি।
জহির বলল, বইটই কিছু দিয়ে যাব? সময় কাটানোর জন্য?
একটা খাবনামা দিয়ে যাবি। বিকট স্বপ্ন দেখি। খাবনামায় স্বপ্নের অর্থ পড়লে মজা লাগবে।
কী রকম স্বপ্ন?
একটা স্বপ্নে দেখলাম আমার হাতে আঙুলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। অনেকগুলি করে আঙুল কিলবিল করছে। মাথাটাথা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ এরকম স্বপ্ন দেখে। নানান হাইপোথিসিস নিয়ে চিন্তা করে করে আমার মাথা গেছে।