মৃন্ময়ী ঘুমুতে যাবার আগে মার সঙ্গে দেখা করতে গেল। তিনি অনেকটা সামলে উঠেছেন। নার্স মালতী রাণী রাতে থেকে যাচ্ছে, যদি রাতে সমস্যা হয়।
শায়লা বললেন, বিন্তি মেয়েটা কেমন কাজ করছে?
মৃন্ময়ী বলল, ভালো। মেয়েটা বুদ্ধিমতী।
শায়লা বললেন, মেয়েটাকে বিদায় করে দে।
মৃন্ময়ী বলল, আচ্ছা।
শায়লা বললেন, কালই বিদায় কর।
মৃন্ময়ী বলল, কারণটা বল।
শায়লা বললেন, কারণ তুই ভালো করেই জানিস।
আমি জানি না।
শায়লা বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ সামলানোর চেষ্টা বুঝা যাচ্ছে। শায়লা চাপা গলায় বললেন, কারণ তুই জানিস না।
না।
তুই নিজে তোর দাদাজানের সঙ্গে বসে শলাপরামর্শ করে এই মেয়েকে বাড়িঘর লিখে দিতে বলিস নি। আমি ম্যানেজার কালামের থেকে খবর পেয়েছি।
মৃন্ময়ী স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও এই কথা!
শায়লা বললেন, তোর কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক কথা!
দাদাজান তার নিজের টাকা নিজের জায়গা-জমি কাকে কী দেবেন সেটা তাঁর ব্যাপার।
শায়লা বললেন, একটা কাজের মেয়ে তার জন্যে বারিধারায় চারতলা বাড়ি?
মৃন্ময়ী বলল, জিনিসটা অন্যভাবে দেখ। মনে কর এই মেয়েটা হঠাৎ একটা লটারির টিকেট পেয়ে গেছে। অনেকেই তো লটারির টিকেট পায়। পায় না?
তোর দাদাজান একটা আধাপাগল মানুষ। তোর দায়িত্ব বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাগলামী সহনীয় পর্যায়ে রাখা। তুই করছিস উল্টোটা। তোর লাভটা কী হচ্ছে?
মৃন্ময়ী বলল, আমার Fun হচ্ছে। আমার জীবনটা খুবই শুকনা ধরনের। এ রকম Fun আমার জন্যে দরকার।
ফুটপাথে ফুটপাথে যখন ঘুরবি তখন ফান থাকবে?
অবশ্যই থাকবে তখনকার ফান অন্য ধরনের হবে। সারাদিন খাওয়া নেই হঠাৎ একবেলা খাওয়া জুটল। মা তুমি কি জান হোটেল সোনারগাঁওয়ের সিস্টেম হচ্ছে গেস্টদের উচ্ছিষ্ট খাবার তারা ফেলে দেয় না। সব জড় করে ভিখিরিদের দিয়ে দেয়। ভিখিরিরা খুব আনন্দ নিয়ে সেই সব খাবার খায়। আমি প্ল্যান করে রেখেছি একদিন ঐ খাবারও খাব।
শায়লা বললেন, ঘর থেকে বের হ!
মৃন্ময়ী বলল, আরও কিছুক্ষণ গল্প করি। আজ আমি গল্প করার মুডে আছি। বাবার কাছ থেকে খুবই ফানি একটা জোক শুনে এসেছি। তুমি শুনবে? হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে যাবে।
শায়লা হাত দিয়ে ইশারা করলেন যেন মৃন্ময়ী চলে যায়।
মৃন্ময়ী নিজের ঘরে চলে এল। রাত বাজছে এগারোটা। তার ঘুম পাচ্ছে। তবে সে এখন ঘুমাবে না। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আজও টেলিফোনটা আসে কি-না দেখা দরকার, তার ধারণা আজ আর আসবে না। কোনো রাতেই আর আসবে না।
বিন্তি চা নিয়ে এসেছে। হালকা লেবু চা। ঘুমুতে যাবার আগে মৃন্ময়ীর চা খাবার অভ্যাস আছে। এখন এক কাপ খাবে। বারোটার সময় বাতি নিভিয়ে এক কাপ খাবে।
বিন্তি বলল, ম্যানেজার সাহেবের কী জানি হইছে।
মৃন্ময়ী বলল, কী হয়েছে?
খুব কানতাছে।
কান্না তো ভালো। বেশি কাঁদলে চোখ সুন্দর হয় এটা জান?
জি না আপা।
বাংলাদেশের মেয়েদের চোখ এত সুন্দর কেন? তারা বেশি কাঁদে এই জন্যেই সুন্দর। আমাকে টেলিফোনটা দাও।
মৃন্ময়ী ছন্দাকে টেলিফোন করল। টেলিফোন ধরলেন ছন্দার বাবা ইয়াকুব। গম্ভীর গলায় বললেন, হ্যালো।
মৃন্ময়ী বলল, চাচা স্লামালিকুম। আমি মৃন্ময়ী।
ইয়াকুব বললেন, গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি। মা কেমন আছ?
ভালো আছি।
ছন্দার সঙ্গে কথা বলবে তো। ও ঘুমায়ে পড়েছে। ডেকে তুলে দেই?
ডেকে তুলতে হবে না। এত সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়ল কেন চাচা? কাল পরীক্ষা।
আর পরীক্ষা। সকাল থেকেই কান্নাকাটি। চোখে পানি নাকে পানি।
কেন?
আমাকে ভেঙ্গে কিছু বলছে না। আমার মেয়েরা এবং আমার স্ত্রী— এরা কেউ কখনও আমাকে ভেঙ্গে কিছু বলে না। কিছুটা বলে বাকিটা অনুমান করে। নিতে হয়।
অনুমান করে কী পেলেন? ছন্দার এত কান্নাকাটি কীসের?
ছেলে পছন্দ হয় নাই। এরচে ভালো ছেলে আমি পাব কোথায়? আমার কি ভালো ছেলের কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ আছে? যে অর্ডার দিব, সেই অর্ডার মতো পাত্র ডেলিভারী হবে।
মৃন্ময়ী বলল, সেটা তো সম্ভব না।
ইয়াকুব বললেন, এখন মা তুমি বিবেচনা কর, ছেলের একটাই দোষ আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। স্ত্রী গত হয়েছে। সেই পক্ষের একটা মেয়ে আছে। এই মেয়েকে তো ছন্দার পালাতে হবে না। মেয়ে থাকে তার নানীর বাড়িতে।
মৃন্ময়ী বলল, পালতে হলে পালবে। সংসারে সৎ ছেলে-মেয়ে থাকতেই পারে, সব কিছু মানিয়ে নিয়েই সংসার।
ইয়াকুব বললেন, তুমি এখন যে কথাটা বললে এমন কথা কেউ বলে না। এটা হলো জ্ঞানের কথা। মাগো তোমাকে যে আমি মা ডাকছি, অন্তর থেকে ডাকছি এটা বুঝতে পারছ?
পারছি।
এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি খুবই ভালো লাগছে। মা তুমি শুনলে অবাক হবে কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলে না। অফিস থেকে এসে ইজিচেয়ারে বসে থাকি। যে যার মতো ঘুরে বেড়ায়। আমার সঙ্গে দুটা কথা বলার সময় কারোর নাই।
ইয়াকুবের গলা ধরে এসেছে। তার চোখে সত্যি সত্যি পানি। তিনি শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। মৃন্ময়ী বলল, চাচা আমি কি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?
ইয়াকুব বললেন, অবশ্যই পার। তোমাকে আমি মেয়ের মতো বিবেচনা করেই মা ডাকি। মেয়ে বাবাকে অনুরোধ করবে না, করবে আদেশ। বল মা তোমার আদেশ কী?
মৃন্ময়ী বলল, ছন্দার এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। তার পছন্দ হয় এমন একটা ছেলের সঙ্গে আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব। পরীক্ষার মাঝখানে বিয়ের যন্ত্রণায় ও পরীক্ষায় খারাপ করবে। ছন্দার ভালো রেজাল্ট করা দরকার।