ফরিদ হড়বড় করে বলল, সকালে যে চেকটা নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলাম সেই চেক ফেরত দিয়েছে।
শাহেদুর রহমান বললেন, সিগনেচার মিলে নাই? দুই দিন পর পর আরেক যন্ত্রণা। আরেকটা চেক লিখে আন। সাইন করে দেই।
ফরিদ ভীত গলায় বলল, ব্যাংক বলছে ফান্ড নেই।
শাহেদুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, ফান্ড নেই মানে কী? ফান্ড গেল কোথায়? গত ছয় মাসের স্টেটমেন্ট নিয়ে এসো।
স্টেটমেন্ট এনেছি স্যার। দেখবেন?
এখন দেখব না, পরে।
টেবিলে রেখে যাব?
তোমার কাছে রাখ, আমি পরে দেখব। আর দয়া করে একটা জিনিস মনে রাখবে— আমি যখন পড়তে বসব তখন আমার ঘরেই ঢুকবে না।
স্যার ভুল হয়েছে।
শাহেদুর রহমান পড়ায় মন দিলেন। লেখক বলছেন যখন ইলেকট্রনকে অবজাৰ্ভ করা হয় তখন সে পার্টিকেল। যখন তাকে অবজার্ভ করা হয় না তখন সে তরঙ্গ। ইলেকট্রনের এই দ্বৈত সত্তা।
ম্যানেজার ফরিদ মৃন্ময়ীর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেও আরেক সমস্যা দরজা যখন বন্ধ থাকবে তখন দরজায় টোকা দেয়া যাবে না। দরজা খোলা থাকলেই টোকা দেয়া যাবে। দরজা বন্ধ।
ফরিদ দরজায় টোকা দিল। মৃন্ময়ী বলল, কে?
ফরিদ বলল, আপা আমি ম্যানেজার ফরিদ। কী চান?
একটা বড় সমস্যা হয়েছে আপা! স্যার বই পড়া ধরেছেন স্যারকে বলতেও পরিছি না।
আমাকে বললে কি লাভ হবে?
ফরিদ জবাব দিল না। কী জবাব দেবে বুঝতেও পারছে না। মৃন্ময়ী বলল, আসুন। ভেতরে আসুন।
ফরিদ আরও হকচকিয়ে গেল। সত্যি কি তাকে ভেতরে যেতে বলছে? নাকি সে ভুল শুনছে। আপার ঘরে সে আগে কখনও ঢুকে নি।
আপা ভেতরে আসতে বলছেন?
হ্যাঁ।
ফরিদ অতি সাবধানে ঢুকল। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের শোবার ঘরে মানুষের পোষাক-আষাকের ঠিক থাকে না। আপা কী অবস্থায় আছেন কে জানে।
মৃন্ময়ী বলল, বলুন আপনার সমস্যা। আগের ব্যাপার না তো? আর্টিস্টকে ক্যাশ টাকা দিতে হবে?
সে রকম কিছু না। ব্যাংকে স্যারের কোনো টাকা নেই। চেক ফেরত এসেছে।
একদিন না একদিন চেক ফেরত আসবেই, এটা তো জানতেন। জানতেন না? দাদাজান সাপ্লাই লাইন অফ করে দিয়েছেন। তিনি যে এই কাজটা করবেন তাও তো আপনার জানা থাকার কথা।
ফরিদ এখনও মাথা নিচু করেই আছে। মৃন্ময়ী বলল, আমাকে এসব বলে কী হবে? যাকে বলার তাকে বলুন।
জি আচ্ছা।
মৃন্ময়ী শান্ত গলায় বলল, আচ্ছা ফরিদ সাহেব প্রতিদিন নিয়ম করে রাত সাড়ে এগারোটার সময় আপনি কি একবার আমাকে টেলিফোন করেন?
ফরিদ চমকে মুখ তুলে তাকাল। তার দৃষ্টি ঘোলাটে। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। পা সামান্য কাঁপছে।
মৃন্ময়ী খাটে আধশোয়া হয়ে আছে। তার হাতে বই, আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে। প্রিপারেশন খুবই ভালো। আর না পড়লেও হয়। তারপরেও একবার চোখ বুলিয়ে যাওয়া। মৃন্ময়ী বইয়ের পাতা উল্টাতে-উল্টাতে বলল, রাত সাড়ে এগারোটায় আমার টেলিফোন বেজে উঠে। আমি কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলতেই লাইন কেটে যায়।
ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, আপা আমার এত সাহস নাই।
তাহলে ঠিক আছে। কিছু মনে করবেন না।
আমি কিছু মনে করি নাই।
Thats good, আচ্ছা আপনি যান।
ঘর থেকে দ্রুত বের হবার সময় দরজার চৌকাঠে মাথা লেগে ফরিদের কপাল ফুলে গেল। চারতলায় উঠার সময় একবার সিঁড়িতে পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে পড়ে গেল।
মৃন্ময়ীদের বাড়ির নিয়ম হলো রাতের খাবার সবাই এক সঙ্গে খাবে। গল্প করতে করতে খাওয়া। এমন যদি হয় একজন কেউ খাবে না। শরীর খারাপ। তাকেও উপস্থিত থাকতে হবে। খাবার টেবিলে দেয়ার পর শাহেদুর রহমান গম্ভীর ভঙ্গিতে বলবেন—Oh God! Thank you for the food.
আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গিয়ে শাহেদুর রহমান এই জিনিস শিখে এসেছেন। তার কাছে মনে হয়েছে God-এর অসীম করুণার কথা প্রতিদিন একবার হলেও মনে করা মানসিক স্বাস্থের জন্যে দরকার।
আজকের খাবার টেবিলে শায়লা বসেন নি। তিনি নিয়ম ভঙ্গ করে তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। চায়নিজ হার্বাল মেডিসিন শেষপর্যন্ত কাজ করে নি। শায়লার অ্যালার্জিক অ্যাটাক হয়েছে। মুখের উপর নেবুলাইজার নিয়ে তিনি আধশোয়া হয়ে আছেন। তার দেখাশোনা করছে একজন নার্স। নার্সের নাম মালতী রাণী। তাকে প্রায়ই এ-বাড়িতে আসতে হয়।
শাহেদুর রহমান প্রার্থনাপর্ব শেষ করে বললেন, কী খবর বিবি?
মৃন্ময়ী বলল, আমার খবর ভালো। তোমার খবর কী?
শাহেদুর রহমান বললেন, দারুণ একটা বই পড়ছি। Holographic Universe, ওয়ান থার্ড পড়ে ফেলেছি। বইটা এত ইন্টারেস্টিং যে ভাত খেতে আসার ইচ্ছাও হচ্ছিল না।
মৃন্ময়ী বলল, ব্যাংকে তোমার না-কি কোনো টাকা নেই?
শাহেদুর রহমান বললেন, খাওয়ার টেবিলে ব্যাংকের আলোচনাটা না করলে হয় না?
হ্যাঁ হয়।
শাহেদুর রহমান বললেন, খাওয়ার টেবিলে আলোচনা হবে হালকা। জোকস চলতে পারে। তুই একটা জোক বল তো।
মৃন্ময়ী বলল, তুমি বল আমি শুনি।
শাহেদুর রহমান খাওয়া বন্ধ করে জোকস মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। মৃন্ময়ীও খাওয়া বন্ধ করে অপেক্ষা করছে।
শাহেদুর রহমান বললেন, জোকস-এর সমস্যা হলো একজন একটা বললে অন্য আরেকটা মনে পড়ে। এক ধরনের চেইন রিএকশান।
মৃন্ময়ী বলল, বাবা শোন দাদাজান কিন্তু তোমার জন্যে ভালো একটা জোকের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।
কী রকম?
সেটা এখন বলব না। খাবার টেবিলে ভারী আলোচনায় যাব না। তবে তুমি তোমার বাবার জোকে খুবই আনন্দ পাবে!
শাহেদুর রহমানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মজার একটা জোক মনে পড়েছে। সামান্য অশ্লীলতা আছে তবে মেয়ের সামনে বলা যায়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন আরেকটা মনে করতে যেটা কোনো দ্বিধা ছাড়াই মেয়েকে শুনানো যায়।