জি না।
কতটুকু আঁকা হয়েছে দেখাও।
জহির আবার দেখাল। আলিমুর রহমান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। নতুন কিছু করা হয়নি। আরও কিছু রঙ ঘসা হয়েছে। এই যুবক কি আসলেই ছবি আঁকা জানে? এতক্ষণ ধরে রঙ লাগানো হচ্ছে। চোখ নাক মুখ কিছু-একটা তো আসবে।
তোমার বোনের স্বামী কী করেন?
খুলনার এক কারখানায় কাজ করত, এখন করে না।
বেকার?
সারি সে এখন পলাতক।
পলাতক কেন?
সে আরো কয়েক জন মিলে একটা মেয়েকে রেপ করেছিল। মেয়েটা মারা গেছে। পুলিশে মামলা চলছে। সে পালিয়ে গেছে ইন্ডিয়া।
তোমার বোন কোথায়?
আমার সঙ্গে থাকে।
বোনের মেয়েটার বয়স কত?
তিন বছর।
তার নাম কী?
টুনটুনি।
তোমার বোনের নাম কী?
মীনা।
তোমার বোনের নাম মীনা।
জি স্যার।
আমার মায়ের নাম ছিল মীনা। আমার বাবা অবশ্য আমার মাকে মিনু। ডাকতেন। তোমার বোনের স্বামী তার স্ত্রীকে কী ডাকে? মীনা ডাকে নাকি মিনু ডাকে।
আদর করে ময়না ডাকে।
তোমার নাম জহির তাই না?
জি স্যার।
ইচ্ছা করলে তুমি সিগারেট খেতে পার।
জহির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়া সিগারেট ধরাল। তার কাজ সে বন্ধ করল না। ঠোঁটে সিগারেট রেখেই সে ব্রাশ টানছে। আলিমুর রহমান বললেন, তোমাকে সিগারেট খাবার অনুমতি কেন দিলাম জান?
জি না।
তুমি তোমার পারিবারিক একটা লজ্জার কাহিনী কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়া বলেছ দেখে আমার ভালো লেগেছে। তোমার বোনের নাম মীনা শুনেও ভালো লেগেছে। মীনা নাম শুনে আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। মার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার বোনের স্বামী বদমাইশটার নাম কী?
সবুজ।
সবুজ কি তার স্ত্রীকে মারধোর করত?
জি না।
আমার বাবা আমার মাকে মারতেন। ছেলে-মেয়েদের চোখের সামনেই মারতেন। আমি আমার মাকে শেষ মার খেতে দেখি যখন আমার বয়স তের। বাবা মার চুলের মুঠি ধরে মারছেন। ছেচড়াতে ছেচড়াতে উঠানে নিয়ে এসেছেন। মার শাড়ি খুলে গেছে। তিনি তিনি… সেই যে আমি ঘর থেকে বের হলাম। আর ফিরে যাই নি।
জহির বলল, আপনার বাবা-মার সঙ্গে আর আপনার দেখা হয় নাই?
আলিমুর রহমান জবাব দিলেন না। জহির দেখল বৃদ্ধের দুই চোখ ভিজে উঠেছে। কঠিন চোখ হঠাৎ ভিজে গেলে অন্য এক ধরনের কোমলতা চলে আসে। জহির তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাকে এই চোখ আঁকতে হবে। মমতায় আর্দ্র চোখ।
জহির!
জি স্যার!
তুমি চলে যাও। আজ আর না।
জহির বলল, স্যার কি একটা সিগারেট খাবেন?
আলিমুর রহমান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দাও একটা খাই।
আমার কিন্তু সস্তা সিগারেট।
আলিমুর রহমান বললেন, আমিও সস্তা মানুষ, অসুবিধা নেই। আমার পুত্র দামী। দামী এবং মহাজ্ঞানী শিল্পবোদ্ধা। সব সময় মুখের সামনে বই।
জহির, তোমার মাছ মারার শখ আছে?
জি না।
তোমার কীসের শখ?
আমার কোনো শখ নেই।
আলিমুর রহমান বললেন, আমার বাবার শখ ছিল খাওয়ার। খেতে পলেই হলো। আর কিছু না। মা মাঝে-মধ্যে মুরগি রান্না করতেন। বাবা কী করতেন শোন। খেতে বসার সময় পুরো পাতিলটা নিয়ে বসতেন। তার খাওয়া শেষ হবার পর যদি কিছু থাকতো আমরা খেতাম। বেশির ভাগ সময় কিছু আলু আর ঝোল থাকতো। ঠিক আছে আজ যাও। এখন আমি আমার মহাজ্ঞানী পুত্রকে একটা চিঠি লিখব। তুমি ঢাকায় যাবে কীভাবে?
বাসে যাব।
ম্যানেজারকে বল গাড়ি দিয়ে যেন পৌঁছে দেয়। আবার যখন আসবে ম্যানেজারকে টেলিফোন করবে। সে গাড়ি পাঠিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে। পাঁচটা মিনিট কি অপেক্ষা করতে পারবে?
অবশ্যই পারব।
তাহলে পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা কর। গাড়ির ড্রাইভার আমার মহাজ্ঞানী পুত্রের কাছে একটা চিঠিও নিয়ে যাবে। চিঠি লিখতে লাগবে এক মিনিট।
আলিমুর রহমান এ ফোর সাইজ একটা কাগজে বড় বড় করে লিখলেন— গাধা। খামের উপর ছেলের নাম ঠিকানা সুন্দর করে লিখলেন। তার মুখে বিজয়ীর হাসি। চিঠি পড়ার পর পুত্রের মুখের ভাব কী হয় এই ভেবেই তাঁর আনন্দ হচ্ছে।
শাহেদুর রহমান লাইব্রেরি-ঘরে পড়ার চেয়ারে বসে আছেন। তার এই বিশেষ পড়ার চেয়ারের ডিজাইন তিনি নিজে করেছেন। একবার তৈরি হবার পর কয়েক দফা সংস্কার করতে হয়েছে। কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। এই চেয়ারটা অনেকটা ডেন্টিস্টদের চেয়ারের মতো। হাত দিয়ে বই ধরতে হয় না। বই রাখার আলাদা স্ট্যান্ড আছে। স্ট্যান্ডে বল বিয়ারিং লাগানো। চোখে আরাম হয় এমন অবস্থায় বইকে রাখা যায়। বসার অবস্থানও বদলানো যায়।
শাহেদুর রহমান এখন পড়ছেন পপুলার সায়েন্সের বই। বইয়ের লেখকের মতে পুরো বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড একটা হলোগ্রাফিক ছবি ছাড়া কিছুই না। মানুষ হচ্ছে হলোগ্রাফিক ইমেজের অবজারভার। ভারতীয় মুণি-ঋষিরা জগৎকে মায়া বলতেন। পদার্থবিদ্যার এই অধ্যাপকও জগৎকে মায়া বলছেন। তবে একটু অন্যভাবে।
শাহেদুর রহমানের কঠিন নির্দেশ আছে পড়াশোনার সময় তাকে কেউ বিরক্ত করতে পারবে না। Extreme Emergency-তেও না। পড়াশোনা ব্যাপারটাই Extreme Energency. এরচে বড় ইমার্জেন্সি হতে পারে না।
বিপদে পরেছে ফরিদ। একটা ঘটনা ঘটেছে। স্যারকে ঘটনা জানানো উচিত। কীভাবে জানাবে বুঝতে পারছে না। ব্যাংক থেকে দু লাখ টাকার একটা চেক ফেরত এসেছে। চেকে সীল দেয়া, পর্যাপ্ত অর্থ জমা নেই। এটা যে কত বড় দুঃসংবাদ সে জানে। স্যার কি জানেন?
ফরিদ চেয়ারের কাছে এসে কাশল। শাহেদুর রহমান বিরক্ত চোখে। তাকালেন। ভুড় কুঁচকে বললেন, কী চাও?