মিউজিক শুনে মৃন্ময়ী হতভম্ব। চার-পাঁচটা মেয়ে শিয়ালের কান্নার মতো হুয়া হুয়া করছে। এদের মধ্যে একজন (মনে হয় সেই দলের লিড সিঙ্গার) একা কিছুক্ষণ হুয়া হুয়া করে। সে থেমে যেতেই বাকিরা ধরে।
বিন্তি দরজা সামান্য খুলে বাইরে থেকে বলল, আপা, আপনেরে নাশতা খাইতে ডাকে।
মৃন্ময়ী বলল, কে ডাকে, মা না বাবা?
খালুজান ডাকেন।
তোমার খালুজানের মানসিক অবস্থা কী? রাগত, নরমাল না হাস্যমুখি?
বিন্তি কিছু বলল না। খালুজানের মুখের দিকে সে ভয়ে তাকাতে পারে না। তিনি রাগ না হাস্যমুখি সে জানে না। জানতে চায় না।
মৃন্ময়ী বলল, বিন্তি তোমাকে না বলেছি ঘর অগোছালো করে রাখবে। শুরু কর। বিছানার চাদরটা মাটিতে ফেলে দাও। দুটা বালিশের একটা বিছানায় থাকবে আরেকটা কার্পেটে। বই আর সিডি সারা ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখ।
বিন্তি ভয়ে ভয়ে বলল, আপা সত্যি বলতেছেন?
মৃন্ময়ী বলল, ভাষা ঠিক ক— বলতেছেন, করতেছেন অফ। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতে হবে— বলছেন, করছেন এই রকম। হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না। নাশতা খেয়ে ফিরে এসে যেন দেখি এ টোটাল মেস। টোটাল মেস শব্দের মানে জান?
না।
টোটাল মেসের মানে হচ্ছে পরিপূর্ণ বিশৃঙ্খলা।
মৃন্ময়ীর বাবা শাহেদুর রহমান চৌধুরী পেশায় একজন আর্কিটেক্ট। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে Water body planning–এ Ph.D. করেছেন। তার রেজাল্ট ছিল অসাধারণ। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত Water body planning এর কোনো ডিজাইন করেন নি। ভবিষ্যতে করবেন এ রকম মনে হয় না। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো পরিশ্রমের কাজ তিনি করতে পারেন না। তাতে অবশ্যি তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শাহেদুর রহমান চৌধুরী সাহেবের বাবা আলিমুর রহমান সাধারণ গেঞ্জি, সুতা এবং রবারের জুতার ব্যবসা করে এত টাকা করেছেন যে তার একমাত্র পুত্রকে জীবিকা নিয়ে কোনো রকম চিন্তা ভাবনায় যেতে হয় নি। অর্থ কী করে মানুষকে অকর্মণ্য করে ফেলে শাহেদুর রহমান তার উদাহরণ। এখন তার সময় কাটে আর্ট কালেক্টর হিসেবে। দেশ-বিদেশের প্রচুর ছবি তিনি জোগাড় করেছেন।
শাহেদুর রহমান বারিধারায় একটা বাড়িতে বাস করেন। বাড়ির চারতলাটা করেছেন ছবির মিউজিয়াম। ছবির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকায় গুলশানে একটা প্লট নিয়েছেন। ছবির মিউজিয়াম সেখানে সরিয়ে নেবেন। মিউজিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। জমির মালিকানা নিয়ে মামলা শুরু হয়ে গেছে। কোর্ট ইনজাংশান দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
নাশতার টেবিলের দিকে মৃন্ময়ীকে আসতে দেখে শাহেদুর রহমান বললেন, হ্যালো বিবি!
এই বিবি সাহেব-বিবির বিবি না, এই বিবি হলো Blue Bird-এর সংক্ষেপ। শাহেদুর রহমান তার মেয়েকে সব সময় বিবি ডাকেন।
মৃন্ময়ী বলল, হ্যালো জিবি (Grey bird)!
শুনলাম তুই পরীক্ষা দিচ্ছিস না।
মৃন্ময়ী বসতে বসতে বলল, কে বলেছে, মা?
হ্যাঁ।
মা কোথায়?
তোর কথা শুনে তার মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে। সে তার ঘরে। প্রেশার মাপার জন্যে ডাক্তার ডাকা হয়েছে।
মৃন্ময়ী পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল, পরীক্ষা দেব না কেন? পরীক্ষা দিচ্ছি। মাকে ভড়কে দেবার জন্য বলেছি পরীক্ষা দেব না।
প্রিপারেশন কেমন?
ভালো। প্রথমদিন Physical chemistry. এই পেপারটার প্রিপারেশন একটু Down,
শাহেদুর রহমান মেয়ের পাউরুটিতে মাখন লাগানো দেখছেন। আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। আগ্রহের কারণ হচ্ছে মাখন লাগানো পাউরুটি মৃন্ময়ী কখনো খায় না। তবে রুটিতে মাখন লাগাতে তার খুবই ভালো লাগে।
শাহেদুর রহমান বললেন, তোর মধ্যে অনেক স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার আছে।
মৃন্ময়ী বলল, তোমার মধ্যেও আছে। বিশাল বিদ্বান এক মানুষ, বিশ পঁচিশ হাজার বই পড়া ছাড়া জীবনে কিছুই করলে না।
সময় তো শেষ হয়ে যায় নি। দেখি তোর মাখন-লাগানো পাউরুটিটা দে। খেয়ে দেখি।
মৃন্ময়ী পাউরুটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, জমি নিয়ে মামলার খবর কী?
কোনো খবর নেই। মামলা চলছে।
তুমি তো ভালো ক্যাচালের মধ্যে পড়েছ।
হুঁ।
তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না তুমি চিন্তিত।
চিন্তিত হয়ে লাভ তো কিছু নেই। লাভ থাকলে বিরাট চিন্তার মধ্যে পড়তাম। তোর মার মতো প্রেশার-ট্রেশার বাড়িয়ে ভূমিশয্য। মামলা শুরু হওয়ায় আমার জন্যে কিন্তু একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে।
কীরকম?
এখন চিন্তা করছি আরো বড় জায়গা নিয়ে কাজ করব। পঁচিশ-ত্রিশ বিঘা জমি। ডিজাইন, Water planing মন লাগিয়ে করা যাবে। পানির মাঝখান থেকে শ্বেতপাথরের বিল্ডিং ভেসে উঠল। জলপদ্ম। ধবধবে শাদা পাথরের ফুল। বিল্ডিংটা এমন হবে যেন মনে হয় সে জলে তার নিজের ছায়া দেখছে।
এ-রকম বিল্ডিং তো আছে। লুই কানের ডিজাইন। আমাদের সংসদ ভবন।
আমারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম।
পুরো বিল্ডিং শ্বেতপাথরের?
হুঁ।
অনেক টাকার ব্যাপার। এত টাকা তোমার আছে?
ব্যাংক থেকে ধার নেব। বাবার কাছে হাত পাতব। বাবার কাছে ভিক্ষা চাইতে লজ্জা নেই।
মৃন্ময়ী চায়ের কাপ হাতে উঠতে উঠতে বলল, দাদাজান তোমাকে একটা পাই পয়সাও দেবে না। কাগজ আন। কাগজে লিখে দিচ্ছি।
শাহেদুর রহমান হাসিমুখে বললেন, বাবাকে রাজি করানো আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।
মৃন্ময়ী বলল, সকালে নাশতা খেতে বসেছ, তোমার হাতে বই নেই এটা কেমন কথা। চায়ে একটা চুমুক দেবে এক পাতা পড়বে। এটাই তো তোমার সিস্টেম।