সবুজ বাসের টিকেট কাটতে গিয়েছিল বিকাল চারটায়। মীনা পাঁচটার সময় কাদো কাঁদো মুখে বলল, ভাইয়া ও টিকিট কাটতে গেছে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে এখনো তো ফিরছে না।
জহির বলল, যেতে-আসতে সময় লাগবে না। তুই অল্পতেই এত অস্থির হয়ে যাস কী জন্যে?
মীনা বলল, ও দশ হাজার টাকার বান্ডেলটা নিয়ে গেছে।
তাতে সমস্যা কী? টিকিট কেটে বাকি টাকা ফেরত আনবে।
ড্রয়ারে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট ছিল। সিগারেটও নিয়ে গেছে।
মীনা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল।
জহির ধমক দিয়ে কান্না থামালো। টুনটুনি তার মাকে ভালো কপি করা শিখেছে। মা কাঁদতে শুরু করলে সে কাঁদতে শুরু করে। মা থামলে সেও থামে।
মীনা বলল, ভাইয়া আমার খারাপ একটা সন্দেহ হচ্ছে। ও মনে হয় চলে গেছে।
জহির বলল, চলে গেছে মানে। কোথায় চলে গেছে।
মীনা বলল, আমি কিভাবে জানি কোথায় গেছে। চলে যে গেছে এটা জানি। ব্যাগে করে নিজের কাপড়-জামাও নিয়ে গেছে। ভাইয়া এখন কী হবে?
জহির সার্ট গায়ে দিচ্ছে। ঘর এখন অসহ্য লাগছে। বাইরে কোথাও যেতে হবে। হাসপাতালে যাওয়া খুবই দরকার, ফজলুর খোঁজ নিতে হবে। গত তিন দিন যাওয়া হয় নি।
মীনা বলল, ভাইয়া কোথায় যাও?
কাজে যাই। জরুরি কাজ আছে।
আমাকে পথে ফেলে চলে যাচ্ছ?
তুই পথে নী। তুই আমার বাসায় আছিস এবং ভালো আছিস।
তুমি ফিরবে কখন?
জানি না কখন ফিরব।
রাত হবে?
হতেও পারে।
মীনা বলল, এর মধ্যে যদি টিয়া বাসের টিকিট নিয়ে ফিরে আসে।
যদি ফিরে আসে তোরা চলে যাবি। বাসায় তালা দিয়ে চাবি বাড়িওয়ালার কাছে রেখে চলে যাবি।
তুমি এ রকম কঠিন গলায় আমার সঙ্গে কথা বলছ কেন?
মীনা আবার ফোস ফোস শুরু করল। টুনটুনিও দেরি করল না।
আর এক মুহূর্ত দেরি করা ঠিক হবে না। জহির উঠে দাঁড়াল।
ফজলু মুখের সামনে তিন দিনের একটা বাসি পত্রিকা ধরে শুয়ে আছে। জহিরকে দেখে সে পত্রিকা নামিয়ে বলল, আমাকে ধরাধরি করে একটু বসিয়ে দে। শুয়ে শুয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। প্রকৃতি চায় না আমরা শুয়ে শুয়ে কথা বলি।
জহির ফজলুকে বিছানায় বসাতে বসাতে বলল, তোর নতুন থিওরি?
ফজলু বলল, থিওরি না হাইপোথিসিস। আমরা কখন শুই? ঘুমানোর জন্য শুই, কাজেই…
শরীরের অবস্থা কী?
ভালো না? ডাক্তাররা বলছে খারাপ ধরনের জন্ডিস। হেপাটাইটিস বি, সি, ডি এর কোনো একটা। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মৃত্যুর প্রস্তুতি কি নিতে শুরু করব?
ডাক্তার এমনভাবে তাকালো যেন পাগলা গারদের কোনো পেশেন্ট।
তোকে সে-রকমই দেখাচ্ছে।
ফজলু আগ্রহের সঙ্গে বলল, মৃত্যুর প্রস্তুতি কিন্তু আমি নিতে শুরু করেছি।
জহির বলল, সেটা কী রকম?
মনকে বুঝাচ্ছি আমাদের পৃথিবীর যে জগৎ সে জগতের চেয়ে মৃত্যুর পরের জগৎ অনেক ইন্টারস্টিং।
জহির বলল, মন বুঝেছে?
ফজলু বলল, না। এখনও না। তবে বার বার একই কথা বললে মন কন্ডিশন্ড হয়ে যাবে। তখন বুঝ মানবে।
জহির বলল, বুঝ মানলে তো ভালোই। এখন কি খাওয়া-দাওয়া করতে পারছিস, না-কি স্যালাইন চলছে?
স্যালাইন চলছে। মাঝখানে একবার জাউ ভাত দিয়েছিল। মুখে দিয়েই বমি করে দিয়েছি। ভালো করেছি না?
জহির জবাব দিল না। ফজলুর মুখ হাসি হাসি। যেন অতি মজাদার কোনো কথা বলেছে। জহির বলল, যে ডাক্তার তোকে দেখছেন তার নাম কী?
ফজলু বলল, তার নাম দিয়ে দরকার কী?
কথা বলতাম। তোর অসুখ কী? চিকিৎসা কী হচ্ছে?
কথা বলার কোনো দরকার নেই। তাদেরকে তাদের কাজ করতে দে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজ করবে। একজন অন্যজনের কাজে ইন্টারফেয়ার করবে না। ডাক্তার করবে ডাক্তারের কাজ, আমি করব আমার কাজ।
এখন তোর কাজটা কী?
ফজলু আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমার বর্তমান কাজ অদ্রুত অদ্ভুত হাইপোথিসিস দাঁড় করানো। আমার আরেকটা হাইপোথিসিস শোন—
জহির বলল, হাইপোথিসিস শুনতে ইচ্ছা করছে না।
আহা শোন না, মজা পাবি। এই হাইপোথিসিসে মৃত্যুর পর আমরা আরেকটা গ্রহে চলে যাব। সেই গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে অনেক সুন্দর। পৃথিবীতে যেমন রোগ-ব্যাধি আছে সেই গ্রহে নেই। সেই গ্রহ ব্যাধিমুক্ত গ্রহ। তবে সেখানে অভাব, অনটন আছে। মানসিক কষ্ট আছে। পৃথিবীর সব মানুষ যে সেই গ্রহে যেতে পারবে তা-না। অনেকের মডেল নষ্ট করে ফেলা হবে।
দ্বিতীয় যে গ্ৰহটাতে আমরা যাব সেখানেও মৃত্যু আছে। মৃত্যুর পর আমাদের স্থান হবে তৃতীয় গ্রহে। দ্বিতীয় গ্রহ থেকে তৃতীয় গ্রহে যাবার সময়ও একদল মানুষ বাদ পড়ে যাব।
তৃতীয় গ্রহ হবে দ্বিতীয়টার চেয়ে বেটার। সেখানে ব্যাধি যেমন নেই, অভাব নেই। একটি ব্যাধি এবং অভাব মুক্ত জগৎ। তবে মানসিক কষ্ট আছে।
সেই জগৎ থেকে আমরা যাব চতুর্থ জগতে। সেই অপূর্ব জগতে কোনো কষ্টও নেই। সেখান থেকে যাত্রা হবে পঞ্চম জগতে।
জহির বলল, এর শেষ কোথায়?
ফজলু বলল, সর্বশেষ জগতটা হলো নবম জগৎ। সেখানে অল্প কিছু মানুষই বাস করবেন। তারা সবাই মুক্ত পুরুষ। মহান সাধু-সন্ত। তারা সর্ব বিষয়েই মুক্ত এমন কি সময়ের বন্ধন থেকেও মুক্ত। তারা তাদের ইচ্ছা মতো যে কোনো জগতে যেতে পারবেন। কেউ কেউ ইচ্ছা করেই যাবেন। এই যে আমরা হঠাৎ হঠাৎ মহাপুরুষদের মত সাধু-সন্তের দেখা পাই তারা আসলে নবম জগতের মানুষ। স্ব-ইচ্ছায় আমাদের জগতে বাস করতে এসেছেন।
জহির বলল, এমন কোনো সাধু-সন্তের দেখা পেয়েছিস?
ফজলু বলল, একজনের দেখা তো অবশ্যই পেয়েছি। আমি নিজে, ঠাট্টা করছি না, এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত।