জহির সকাল থেকে কামরুল হাসানের তুলির টান দিচ্ছে। দুটি দাঁড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। দুটাই বকের ছবি। একটাতে বক মাছ খাচ্ছে। তার ঠোঁটে মাছ। অন্যটাতে উড়ার প্রস্তুতি হিসেবে পাখা মেলেছে। জুহিরের ধারণা কামরুল হাসান এই ছবি দুটি দেখলে নিজেও খুশি হতেন।
মীনা টুনটুনিকে টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছাতে ভাইয়ের সামনে এসে দাড়াল। কঠিন মুখে বলল, ভাইজান আমি ঠিক করেছি আজ চলে যাব।
জহিল বলল, আচ্ছা।
রাতে বাস যায়। রাতের বাসে যাব।
ঠিক আছে।
খালি হাতে আমি শ্বশুরবাড়িতে উঠতে পারব না। তুমি টুনটুনিকে সোনার কিছু দিবে বলেছিল। আমাকে টাকা দাও। আমি কিনে আনব।
এখন আমার হাতে কোনো টাকাপয়সা নাই। তোরা চলে যা, আমি টাকা মানিঅর্ডার করে পাঠাব।
মীনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তোমার বোন না পথের ফেলনা। ঠিক করে বল তো ভাইয়া। দশ দিন ধরে আছি। তুমি টুনটুনির বাবার সঙ্গে একটা কথা বল না। বেচারা একা বারান্দায় বসে থাকে। সামান্য কয়েক পেকেট সিগারেট কিনেছে, এই নিয়েও তুমি কথা শুনিয়েছ।
জহির বলল, কথা শুনাইনি তো। বলেছি অন্যের পয়সায় এত দামি সিগারেট খাওয়ার দরকার কী? আমি নিজে তো দেশীটা খাই।
দু দিনের জন্যে বেড়াতে এসে দামি সিগারেট যদি খায় তাতে অসুবিধা কী?
জহির হতাশ গলায় বলল, কোনো অসুবিধা নাই। বেশি করে খেতে বল। এখন সামনে থেকে যা।
মীনা কাঁদতে কাঁদতেই সামনে থেকে বের হয়ে গেল। এখন টুনটুনির কান্নাও শোনা যাচ্ছে। মীনা রাগ ঝাড়তে গিয়ে মেয়ের গালেও চড়থাপ্পড় লাগিয়েছে। সে কখনও একা কেঁদে শান্তি পায় না।
জহির ছবি হাতে উঠে পড়ল। কান্নাকাটির মধ্যে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
কুদ্দুস সাহেব স্কেচ দুটি ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ দেখলেন। কিছুই না বলে ড্রয়ার থেকে দশ হাজার টাকার একটা ব্যান্ডেল দিয়ে বললেন চা খাবেন?
জহির বলল, খাব।
কুদ্দুস বলল, জয়নুলের নকল করেন। উনি নিজেই নিজের ছবি প্রচুর নকল করেছেন। উনার ভালো ভালো ছবির চার পাঁচটা জেনুইন ভার্সান আছে। আপনার হাত ভালো। আপনি যদি করেন কোনো শালা ধরতে পারবে না। আপনাকে আমরা ঠকাব না।
জহির বলল, ঠিক আছে।
কবে দিবেন বলেন। আমার কাছে পার্টি আছে।
তাড়াতাড়িই দিব।
উনার দুর্ভিক্ষের কাক কিন্তু আঁকবেন। ডাস্টবিনের ময়লার পাশে শিশু, কাক এইসব। বিদেশীরা লুফে নিবে।
ঠিক আছে বক আর আঁকব না। এখন থেকে কাক।
আপনার ঐ বন্ধু কোথায়? ফজলু সাহেব। উনার হাতও ভালো।
জহির সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, শুধু হাত ভালো হলে হয় না, কপালও ভালো থাকতে হয়। তার কপাল মন্দ। সে হাসপাতালে। এখন মরে মরে অবস্থা।
বলেন কি! কোন হাসপাতাল? কত নম্বর কি বলুন তো একবার দেখতে
জহির উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, খামাখা হাসপাতালের নাম দিয়ে কী করবেন? আপনি যে দেখতে যাবেন না সেটা আপনিও জানেন আমিও জানি।
জহির বাসায় ফিরে বোনের হাতে টাকার বান্ডেলটা দিয়ে বলল, যা টুনটুনির জন্যে কিছু নিয়ে আয়।
মীনা গম্ভীর গলায় বলল, এখানে কত আছে?
দশ আছে।
এতে তো এক ভরিরও কিছু হবে না। সোনার ভরি এখন তেরো হাজার।
যা হয় তাই কিনবি এবং রাতের বাসে বিদায় হয়ে যাবি। আমি পথের ফকির। এই জিনিসটা যেদিন বুঝবি সেই দিন আবার বেড়াতে আসিস।
মীনা বলল, আমি আর কোনো দিনও আসব না। আমি যদি বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে থাকি তাহলে তুমি আর কোনো দিন আমার মুখ দেখবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে। চিৎকার বন্ধ।
এই রইল তোমার টাকা। তোমার এই টাকা যদি আমি নেই তাহলে যেন আমার হাতে কুষ্ঠ হয়।
মীনা কাঁদছে। মীমার মেয়ে কাঁদছে। জহিরের বিরক্তির সীমা রইল না। বিকালের দিকে মীনা স্বাভাবিক। এক কাপ চা জহিরের সামনে রাখতে রাখতে বলল, ভাইয়া আমি ঠিক করেছি দশ আনার মধ্যে একটা চেইন কিনব। তোমার অবস্থাও তো দেখতে হবে। তোমার যে এমন খারাপ অবস্থা এটাও তো জানি না।
জহির বলল, তোরা কি রাতে যাচ্ছিস?
টিয়াকে পাঠিয়েছি টিকেট কাটতে। টিকিট পেলে অবশ্যই চলে যাব।
ঠিক আছে যা। এতদিন ঢাকায় পড়ে থাকারও কোনো মানে নেই।
ভাইয়া তুমি বলেছিলে টুনটুনির ছবি এঁকে দিবে।
জহির বলল, তুই মেয়ে কোলে নিয়ে সামনে বোস। একে দিচ্ছি।
শাড়ি বদলে চুল বেঁধে আসি?
কিছুই করতে হবে না। আমি তো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছি না।
মীনা মেয়ে কোলে নিয়ে বসল। জহির বলল, কথা বলবি না। চুপচাপ বসে থাকবি।
মীনা বলল, কতক্ষণ লাগবে?
জহির বলল, দশ মিনিটও লাগতে পারে আবার দশ ঘণ্টাও লাগতে পারে।
দশ মিনিটের বেশি হলে কিন্তু আমি পারব না। আচ্ছা ভাইজান তুমি টিয়ার সঙ্গে কথা বল না কেন? আজ চলে যাবে তো। ওকে ডেকে ওর সঙ্গে একটু কথাটথা বল।
আচ্ছা বলব। তোর বরের আসল নাম কী?
মীনা হতভম্ব হয়ে বলল, তুমি ওর নাম জান না?
ভুলে গেছি। মানুষ ভুলে যায় না।
মীনা থমথমে গলায় বলল, ওর নাম সবুজ। থাক তোমাকে আর ছবি আঁকতে হবে না।
মীনা মেয়ে কোলে নিয়ে উঠে গেল।
পাশের ঘর থেকে মীনার ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই মেয়ে কাঁদতে শুরু করবে। শুরু হবে কোরাস। জহির ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। টুনটুনির চেহারা চলে এসেছে মীনার খানিকটা এসেছে। ছবিটা ভালো লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে এই ছবিতে আর কাজ না করলেও হবে। সামান্য শেড অবশ্যি দেয়া যায়। না দিলেও তেমন ক্ষতি হবে না। টুনটুনিকে সুন্দর লাগছে ছবিতে। বাচ্চাটার চেহারায় অন্য রকম মায়া আছে। ছবি আঁকার আগে ব্যাপারটা জহির লক্ষ করেনি। জহির আগ্রহের সঙ্গে ছবিতে নিজের নাম সই করল।*