না-শুনেই কীভাবে বুঝলি ভালো লাগে না?
না-শুনেই আমি বুঝতে পারছি খুবই বোরিং গল্প। তোমার বেশিরভাগ গল্পই বোরিং, মামলার গল্প আরো বেশি বোরিং। বাবা আমি যাচ্ছি।
আজহার সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণ আগে রোদ উঠেছে, এরমধ্যেই রোদ কেমন কড়া হয়ে গেছে। সুচের মতো গায়ে রোদ বিধে যাচ্ছে।
মীরা বারান্দায়। রোলে পা মেলে সে মোড়ায় বসে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো লাগছে। তারপরও মনোয়ারা বারান্দায় এসে মীরাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কী সুন্দরই না মেয়েটাকে লাগছে! ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে। এই মেয়েটা তার বাবার মতো সুন্দর হয়েছে। শেফা বেচারি তার বাবার কিছুই পায়নি। কেমন ভোতা নাক মুখ। গায়ের রঙটা পেলেও তো কাজ হত। মীরা মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা তুমি এই ভয়ংকর কাণ্ডটা কী করে করলে?
মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কী করেছি?
দেলোয়ার নামের লোকটাকে সঙ সাজানোর বুদ্ধি তোমাকে কে দিল? লুঙ্গির উপর হলুদ একটা কোট পরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে যে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে সে বুঝতেও পারছে না। মনে হচ্ছে মহাখুশি।
গ্রামের মানুষ অল্পতেই খুশি হয়।
মা প্লিজ লোকটাকে বলে সে হয় কোট খুলে ফেলুক, কিংবা লুঙ্গির বদলে প্যান্ট পরুক। প্যান্ট না থাকলে বাবার একটা প্যান্ট দাও। ক্লাউন যখন সাজবে পুরোপুরি সাজুক।
হাতমুখ ধুয়েছিস? নাশতা দেব?
কী নাশতা?
ভাপা পিঠা।
ভাপা পিঠা খাব না। পরোটা ভেজে দিতে বল।
পরোটা ভেজে দিচ্ছি। একটা পিঠা খেয়ে দেখ, খেতে ভালো হয়েছে।
যত ভালোই হোক খাব না। মিষ্টি-কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
মনোয়ারা চলে যাচ্ছিলেন। মীরা বলল, মা আরেকটা জরুরি কথা শুনে যাও।
কী কথা?
আমি নেত্রকোনা যাব। গাড়িটা নিয়ে যাব। দেলোয়ারকে বল সে যেন আমার সঙ্গে যায়।
নেত্রকোনা কীজন্যে?
আমার কাজ আছে।
ঢাকায় টেলিফোন করবি?
হুঁ। আমাকে টেলিফোন করতেই হবে।
তোর বাবা রাগ করবে।
রাগ করলে তুমি রাগ সামলাবে। আমাকে যেতেই হবে মা।
তো সমস্যাটা কী?
আমার সমস্যা ভয়াবহ।
ভয়াবহ মানে কী? আমাকে বলা যায়?
আজ যদি টেলিফোনে সাবেরকে পাই তাহলে তোমাকে সমস্যাটা বলব।
মনোয়ারা বললেন, মীরা তুই এক কাজ কর। তোর বাবা বাগানে আছে। তার কাছে গিয়ে বোস। আমি তোর নাশতা সেখানে দিচ্ছি।
কেন?
বেচারি একা বসে আছে। তুই পাশে গিয়ে বসলে খুশি হবে। তখন তোর নেত্রকোনা যাওয়া সহজ হবে। তোর বাবা রাগ করবে না।
মীরা গম্ভীর হয়ে বলল, মা তুমি সবকিছু নিয়ে কৌশল কর, প্যাচ খেলে, এইটাই আমার খারাপ লাগে। তোমার মাথার মধ্যে সবসময় কৌশল খেলা করে। তুমি সহজ সাধারণভাবে কিছু করতে পার না কেন?
সংসার ঠিকঠাক রাখতে হলে কৌশল লাগেরে মা। এখন বুঝবি না— আরো বয়স হোক তখন বুঝবি।
বয়স আমার কম হয় নি—একুশ।
একশ একটা বয়স হল?
মীরা বাগানের দিকে রওনা হল। তার মেজাজ খারাপ। মার ওপর রাগ লাগছে। তার নেত্রকোনা যাবার মতো সাধারণ একটা ব্যাপারেও মা একটু প্যাচ খেলবে।
আজহার সাহেব তার বড় মেয়েকে দেখে এত খুশি হলেন যে তার প্রায় চোখে পানি এসে যাবার মতো ব্যাপার হল। তিনি উজ্জ্বল গলায় বললেন, কেমন চনমনে রোদ উঠেছে দেখেছিস মা?
মীরা বলল, হ্যাঁ। এখনতো রীতিমতো গরম লাগছে। সকালে দেখলাম। কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর এখন রোদ ঝা-বা করছে। বাবা শোনো, আমি একটু নেত্রকোনা যাব। আমাকে ঢাকায় টেলিফোন করতে হবে। গাড়িটা নিয়ে চলে যাই? দেলোয়ার সঙ্গে থাকবে, বাবা আমি কি যাব?
আজহার সাহেব বললেন, যা। রাস্তা খানিকটা ভাঙা আছে, সাবধানে চালাবি। আরেকটা কথা, দেলোয়ার বয়সে তোর চে বড়। দেলোয়ার না বলে দেলোয়ার ভাই বল্। খুশি হবে। নাশতা করেছিস?
না। মা এখানে নাশতা নিয়ে আসবে।
ভেরি গুড। খোলামেলা জায়গায় বসে নাশতা খাবার মজাই অন্যরকম।
নাশতার প্লেটে পাখি ইয়ে না করে দিলেই হল।
আজহার সাহেব হো হো করে হেসে ফেললেন। তার হাসি আর থামছেই না। মীরা ভেবে পাচ্ছে না সে এমন কী কথা বলেছে যে বাবার হাসি থামছে না।
মনোয়ারা নাশতা নিয়ে এলেন। তিনি আজহার সাহেবের জন্যে আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছেন।
আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মনোয়ারা বললেন, এই শোনো মীরার ঢাকায় একটা টেলিফোন করা দরকার। ওদের পরীক্ষা নিয়ে কি জানি ঝামেলা আছে। সেই সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। দেলোয়ারকে বলে দেই সঙ্গে যাক। নেত্রকোনা থেকে আমারো দু-একটা জিনিস আনানো দরকার। মীরা গেলে আমার জন্যেও ভালো। মীরা দেখেশুনে আনতে পারবে।
মীরার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। মা অকারণে এত কাঁদুনি গাইছে কেন?
শেফা খুব আয়োজন করেই মাছি মারতে বসেছে। পুকুরপাড়ে তার জন্যে বড় একটা শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। শেফা যে জায়গায় বসেছে সেখানে রোদ আসে বলে বাঁশের মাথায় ছাতা বাধা হয়েছে। তার হাতে দুটা বঁড়শি আছে। এর মধ্যে একটা আবার হুইল বঁড়শি। হুইল বঁড়শি কী করে টানতে হয় শেফা জানে না। সাধারণ বঁড়শি টানার নিয়ম ও জানে না। শুধু এইটুকু জানে ফাৎনা পানির নিচে তলিয়ে গেলে হ্যাচকা টান দিতে হয়। শেফা ঠিক করে রেখেছে যদি হুইলের বঁড়শির ফাৎনা ডুবে যায় তাহলে সে বাবা বলে বিকট চিৎকার দেবে। বাকি যা করার বাবা করবেন। দেলোয়ার ভাই থাকলে হত, তিনি মীরা আপার সঙ্গে নেত্রকোনা গিয়েছেন। শেফার তাদের সঙ্গে যাবার ইচ্ছা করছিল। ইচ্ছাটা সে প্রকাশ করেনি, কারণ ইচ্ছে করলে লাভ নেই। মীরা আপা তাকে নেবে না।