চায়ের কাপ হাতে শেফা আসছে। এক হাতে চায়ের কাপ অন্য হাতের পিরিচে দুটা ভাপা পিঠা। মেয়েকে দেখে আজহার সাহেবের মনখারাপ ভাবটা দূর হয়ে গেল। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, গুড মর্নিং মা। শেফা বলল, গুড মনি। তোমার জন্যে চা আর পিঠা নিয়ে এসেছি।
খুব ভালো করেছিল।
চা মনে হয় আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তোমাদের গ্রামে এত শীত কেন বাবা?
তোমাদের গ্রাম বলছিস কেন? এটাতো তোরও গ্রাম। তোর গ্রাম কি আলাদা? মীরার ঘুম ভাঙে নি?
ভেঙেছে। চা খেয়ে আবার লেপের ভেতর ঢুকে গেছে। আপা বলেছে রোদ না উঠলে সে লেপ থেকে বের হবে না।
তোর ব্রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?
ঘুম ভালো হয়েছে। তবে ঘুমুতে গেছি অনেক রাতে।
কেন?
কাল শোয়া নিয়ে খুব সমস্যা হয়েছে। প্রথমে গেলাম আপার সঙ্গে ঘুমানোর জন্যে। আপা রাজি হল না। তারপর একা-একা ঘুমুতে গেলাম। প্রায় ঘুম চলে এসেছে তখন দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলে দেখি দাদীমা, উনি না-কি আমার সঙ্গে ঘুমুবেন। দাদীমা অনেক রাত জেগে গল্প করলেন।
তাহলে তো ভালোই মজা হয়েছে।
খুবই মজা হয়েছে বাবা।
শেফার আসলে কোনোই মজা হয় নি। দাদীমা রাতে একফোঁটা ঘুমায়নি, সারাক্ষণ কথা বলেছে। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেছেন যে শেফা হতভম্ব। যেমন হঠাৎ শেফার বুকে হাত দিয়ে বলেছেন—কিরে বেটি দুধ এত ছোট ক্যান? শেফা প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, দাদীমা যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বললেন—
হরিণ সুন্দর চোখে
নারী সুন্দর বুকে।
শেফা বলল, দাদীমা গায়ে হাত দিও না। কাতুকুতু লাগে। তিনি কুটকুট করে হাসতে হাসতে বললেন, জামাটা খোল বুক কেমন দেখি।
কী আশ্চর্য কথা। এইসব তো আর কাউকে বলা যায় না। বলা ঠিকও হবে। দাদীমা কিছু উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করলেও মানুষটা খুবই ভালো। শেফার তাকে মোটামুটি পছন্দ হয়েছে।
দাদীমার সঙ্গে কী গল্প হল রে শেফা?
অনেক গল্প হয়েছে। বেশির ভাগ গল্পই দাদাজানকে নিয়ে। দাদাজান নাকি তারজন্যে একেবারে পাগল ছিল। তিনি চোখের আড়াল হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেন। বাইরের লোকজন এসেছে দাদাজানের সঙ্গে কথা বলতে, এখনো নাকি দাদীজানকে খুব কাছেই পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এমন জায়গায় দাঁড়াতে হত যেন পর্দার নিচে দিয়ে দাদাজান তাঁর পা দেখতে পান কিন্তু বাইরের লোকজন কিছু দেখতে পায় না। বাবা এইসব কি সত্যি?
হুঁ সত্যি। বাবা স্ত্রৈণ প্রকৃতির ছিলেন। আমার মা অত্যন্ত ভাগ্যবতী।
এইরকম ভাগ্যবতী হলে আমি বিষ খেয়ে মরে যাব। একটা পুরুষ। সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ভাবতে তো কুৎসিত লাগছে। ছিঃ।
আজহার সাহেব হেসে ফেললেন। শেফার কথাবার্তা তার ভালো লাগছে। মেয়েটা তো বেশ মজা করে কথা বলে।
বাবা!
হুঁ।
দাদাজান নাকি মৃত্যুর আগে-আগে ঘোষণা করেছিলেন এই পুকুরের মাছ তার বংশধরেরা কেড় যেতে পারবে না। তাদের জন্যে পুকুরের মাছ নিষিদ্ধ।
তা বলেছিলেন।
কেন বলেছিলেন?
তাতো মা জানি না। বাবা মারা যাবার সময় আমি গ্রামে ছিলাম না। আমি থাকলে জিজ্ঞেস করতাম।
তুমি এই পুকুরের মাছ খাও না?
আমি কি এখানে থাকি যে মাছ খাব?
মাছ যদি মারা হয় তুমি যাবে?
কী দরকার? একজন মানুষ মৃত্যুর আগে একটা কথা বলে গেছে। কথাটা মানতে অসুবিধা কী?
আমি ঠিক করেছি বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরব। তারপর নিজেই মাছ রান্না করব। সবাইকে খাওয়াব। তোমাকেও খাওয়াব।
আজহার সাহেব হাসলেন। রোদ উঠেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কেটে গেছে। চারদিক ঝকঝক করছে। কুয়াশায় ভেজা গাছের পাতায় আলোর ঝলমলানি।
আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, শেফা যা মীরাকে ডেকে নিয়ে আয়। রোদ উঠেছে। তোদের দুই বোনকে আমি অদ্ভুত একটা কাহিনী বলব— স্টেট ভার্সাস শেফালি রানীর বিখ্যাত মামলা। ইংরেজের আমলের মামলা। কোলকাতা হাইকোর্ট থেকে শেষপর্যন্ত প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গিয়েছিল। যেমন সেনসেশনাল মামলা, তেমনি সেনসেশনাল রায়। যা মীরাকে ডাক।
ডেকে লাভ হবে না বাবা। আপা আসবে না।
আসবে না কেন?
আসবে না কারণ তার আসলে খুব মন খারাপ।
কেন?
যেদিন আমরা এখানে আসব, তার আগের দিন সাবের ভাইয়ের সঙ্গে আপার খুব ঝগড়া হয়েছে।
সাবের ভাই মানে কি লম্বা ছেলেটা?
হ্যাঁ। আমি ডাকি লম্বু ভাইয়া। আপা তাতে রাগ করে।
সাবের ছেলেটার সঙ্গে মীরার ঝগড়া হয়েছে? তোকে বলেছে?
তুমি পাগল হয়েছ বাবা? আপা আমাকে কিছু বলবে? টেলিফোনে ঝগড়া হল তো, আমি আড়াল থেকে শুনলাম। টেলিফোন শেষ করে দরজা বন্ধ করে আপার যে কী কান্না। হাউ মাউ করে কেঁদেছে।
তোর মা জানে?
মা ভাব করে সে কিছুই জানে না। আসলে সবই জানে।
আমাকে তো কিছু বলে নি।
তোমাকে কেন বলবে?
আমাকে বলবে না কেন? আমি কি বাইরের কেউ যে আমাকে কিছু বলা যাবে না?
তুমি ঘরের হলেও তুমি হচ্ছ পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষকে সবকিছু বলা যায় না।
ঝগড়া হয়েছে ভালো কথা। এই বয়সে ক্লাস-ফ্রেন্ডদের মধ্যে ঝগড়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই বলে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে হবে?
কাঁদতে হলে তো দরজা বন্ধ করেই কাঁদতে হবে। দরজা খোলা রেখে কে কাদবে? বাবা আমি যাচ্ছি।
বোস আরেকটু। স্টেট ভার্সেস শেফালি রানীর গল্পটা শুনবি?
না। মামলা মোকদ্দমার গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে না বাবা।