আজহার সাহেবের দাদা মুনশি হেলালউদ্দিন এই বাগান করেছিলেন। মুনশি হেলালউদ্দিন মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এক রাতে স্বপ্ন তিনি কয়েকটা রোগের ঔষধ পেয়ে যান। শিক্ষার পাশে-পাশে লোকজনদের অষুধ দেয়া শুরু করেন। কামেলা রোগের অষুধ এবং সূতিকার অষুধ। তার যখন খুব নাম-ডাক হল, দূরের গ্রাম থেকে বোতল নিয়ে অষুধের জন্য লোকজন আসতে শুরু করল, তখন তিনি হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন। তাকে নাকি অষুধ না-দিতে স্বপ্নে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অষুধ নিতে এসে লোকজন ফেরত যেতে শুরু করল। এতে তার নাম আরো ছড়িয়ে পড়ল। লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল। তার কিছুদিন পর গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল মুনশি হেলাল উদ্দিন পীরাতি পেয়েছেন। শুধু যে পীরাতি পেয়েছেন তাই না, তাঁর পোষা দুটা জ্বীনও আছে। রাতে দরজা বন্ধ করে তিনি জ্বীনদের সঙ্গে কথা বলেন। জ্বীনদের সঙ্গে জিকির করতে বসেন। নতুন পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ এবং পানিপড়া নেবার জন্যে দলে দলে লোক আসতে লাগল। তিনি পানিপড়া এবং তাবিজ দিতে শুরু করলেন। অবিবাহিত মেয়েদের দিতেন সূতাপড়া। কালো রঙের সুতায় ফুঁ দিয়ে দিতেন। সেই সূতা খোপায় চুলের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হত। সূতা বাধার দশদিনের ভেতর বিয়ের সম্বন্ধ আসত। নিয়ম হচ্ছে প্রথম যে-সম্বন্ধ আসবে সেখানেই মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। খোপায় সূতা বাঁধা অবস্থায় আসা সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।
মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি করে অনেক টাকাপয়সা জমিজমা করেছিলেন। তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে পাকা বাড়ি তোলেন। বাড়ির নাম হয়ে যায় পীরবাড়ি।
হেলালউদ্দিন সাহেবের শেষ জীবন সুখের হয়নি। মাথাখারাপের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। রাতে বা দিনে কখনোই ঘুমাতে পারতেন না। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমুনি আসত, তিনি চোখ বন্ধ করেই সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতেন। সবার ধারণা তার পোষা দুটা জীন বিগড়ে গিয়েছিল। তারাই তাকে যন্ত্রণা করত জ্বীন দুটার একটার নাম হবিব আর একটার নাম জাবির। দুজনের বয়সই চারশর উপর। দুটাই অবিবাহিত। এদের বাড়ি কোহকাফ নগরে। এদের মধ্যে একজন জ্বীন (হবিব) আগে হিন্দু ছিলেন পরে মুসলমান হয়েছেন।
লোকশ্রুতি হল মুনশি হেলালউদ্দিন মৃত্যুর সময় ইচ্ছা করে জ্বীন দুটাকে আজাদ করে যাননি। তারা পীরবাড়িতেই আটকা পড়ে আছে। আমৃত্যু তাই থাকবে। গ্রামের অনেক লোক গীরবাড়ির ছাদে দুটা আগুনের হলকাকে নাচানাচি করতে দেখেছে। কেউ কেউ এখনো দেখে।
মনোয়ারা এবং আজহার সাহেব খেজুরের রসের গ্লাস হাতে নিয়ে মুনশি হেলালউদ্দিন সাহেবের শখের বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আম-কাঁঠালের বাগান, মাঝখানে কয়েকটা জলপাই গাছ আছে। জলপাই গাছের জায়গাটা আসলেই সুন্দর। জলপাই গাছের শুকনো পাতার রঙ গাঢ় লাল। শুকনো পাতা পড়ে গাছের নিচটা এমন হয়েছে যে মনে হয় কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। দু বছর আগে সবচে বড় জলপাই গাছের গুঁড়ি আজহার সাহেব বাধিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি সেই বাঁধানো গাছের নিচে বসে আছেন।
মনোয়ারা বললেন, প্রায় দশ বছর পর খেজুরের রস খাচ্ছি।
আজহার সাহেব বললেন, খেতে কেমন লাগছে?
মনোয়ারা মুগ্ধ গলায় বললেন, ভালো। খুবই ভালো। বলতে বলতে আগ্রহ নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলেন। আসলে তার মোটেই ভালো লাগছে না। কেমন বমি চলে আসছে, গন্ধটাও খারাপ কেমন পচা-পাতা পচা-পাতা গন্ধ।
স্বামীকে খুশি করার জন্যে রস খেয়ে মুগ্ধ হবার অভিনয় তাকে করতে হচ্ছে। একজন আদর্শ মহিলাকে অভিনয় করায় অত্যন্ত পারদর্শী হতে হয়। তাদের জীবনের একটা বড় অংশ কাটে আনন্দিত এবং মুগ্ধ হবার অভিনয় করে।
শুকনো পাতা মাড়িয়ে দেলোয়ার আসছে। দেলোয়ারের গায়ে মাপে বড় হলুদ রঙের একটা কোট। কোটটা আজ সকালেই মনোয়ারা দেলোয়ারকে দিয়েছেন। আজহার সাহেবের কোট। পুরানো হলেও এখনো ভালো। দেলোয়ারের হাতে কেরোসিনের চুলা, এলুমিনিয়ামের একটা কড়াই। মটরটি সিদ্ধ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে সে এসেছে।
চাচাজী চলেন যাই।
আজহার সাহেব বললেন, দেলোয়ার থাক বাদ দাও।
মনোয়ারা বললেন, বাদ থাকবে কেন? চল আমরা দুজন যাই।
মেয়েরাই ব্যাপারটা এনজয় করত, ও যখন যেতে চাচ্ছে না তখন থাক। দেলোয়ার তুমি চলে যাও।
দেলোয়ার চলে গেল। চাচাজীর সামনে থেকে যে সে সরে পরার সুযোগ পেয়েছে তাতেই সে খুশি। আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মা নাস্তা বানাচ্ছেন, তুমি মাকে সাহায্য কর। আর আমার জন্যে এখানে চা পাঠিয়ে দিও।
রোদ ওঠেনি। তুমি কুয়াশার মধ্যে একা বসে থাকবে? ঠাণ্ডা লাগবে তো। ঘরে চলে এসো।
কুয়াশা থাকবে না, রোদ উঠবে।
মনোয়ারা চলে গেলেন। বাগানে একা-একা হাটতে আজহার সাহেবের খারাপই লাগছে। মটরশুঁটি খাবার আইডিয়াটা ভালো ছিল। মেয়েরা রাজি হল না। মেয়েরা অনেক দূরে সরে গেছে। গ্রামের মধ্যে বন্ধু বান্ধব নেই, টেলিফোন নেই, টিভি নেই, মিউজিক সিস্টেম বা শপিং নেই, কাজেই তিনি ধারণী করেছিলেন তারা কাছাকাছি আসবে। বাধ্য হয়েই বাবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাবে। তিনি তাদের সঙ্গে নানান গল্প-গুজব করবেন ওরা কী ধরনের গল্প পছন্দ করে তা তিনি জানেন না। মামলার কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, সেইসব গল্প করা যেতে পারে। স্টেট ভার্সেস শিউলি রানীর মামলাটা তাদের পছন্দ হবার কথা। এই মামলাটায় কিছু অস্বাভাবিক এবং নোংরা ব্যাপার আছে। এই ব্যাপারলি বাদ দিয়ে বলতে হবে। মামলার যেদিন রায় হয় তার আগের দিন শিউলি রানী হঠাৎ ঘোষণা দিল সে আসলে নারী না, পুরুষ এবং বিজ্ঞ আদালতকে বলল তাকে ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর জন্য। আদালত স্তম্ভিত। কারণ শিউলি রানী বিবাহিত, তার দুটা ছেলে আছে। স্বামী জীবিত… এই গল্প এদের পছন্দ না হয়েই পারে না।