ঝাল পিঠা আমি খাই না। তাছাড়া আমার শরীর ভালো লাগছে না। ব্লাতে আমি কিছুই খাব না। মা শোনো, তুমি কি একটা কাজ করবে?
কী কাজ।
দেলোয়ার লোকটাকে বলবে সে যেন হুটহাট করে আমার ঘরে না ঢোকে। সন্ধ্যাবেলা ঘুমুচ্ছি, হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ল।
গ্রামের ছেলে তো। এই ব্যাপারগুলি জানে না।
তুমি কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন মা। তুমি তাকে বলে দেবে সে যেন আমার ঘরে এই ভাবে না ঢোকে।
আচ্ছা আমি বলে দেব।
সে আমাকে আপামণি ডাকে। অসহ্য। তাকে বলবে যেন আপামণি না ডাকে।
আচ্ছা।
মা তোমার সঙ্গে আরেকটা শেষ কথা। আমি যে নৌকায় বলেছিলাম তোমার গা থেকে কাদামাটির গন্ধ আসে। আসলেই আসে।
ও আচ্ছা।
কিন্তু এই গন্ধটা যে আমার কী ভালো লাগে তুমি জানো না। তুমি রাতে। ঘুমুতে যাবার আগে তোমার গায়ের গন্ধ আমাকে দিয়ে যাবে। ব্লাউজ খুলে আমি তোমার বুকে নাক ঘষব।
মনোয়ারা বিরক্ত মুখে বললেন, তুই কী যে হচ্ছিস! তাঁর বিরক্তির অভিনয়টা তেমন ভালো হল না। তার মুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল।
বারান্দায় দেলোয়ার একটা মাটির মালশী নিয়ে আসছে। মালশী থেকে ঝুকা ঝুকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়ায় দেলোয়ার চোখ মেলতে পারছে না, এমন অবস্থা। মনোয়ারা বললেন, মালশায় কী দেলোয়ার?
দেলোয়ার লজ্জিত হয়ে বলল, ধূপ চাচীআম্মা। তাকে যে-কোনো প্রশ্ন, করলেই সে খানিকটা লজ্জা পায়।
ধূপ জ্বালিয়েছ কেন?
মশার খুব উপদ্রব। আপামণির ঘরে ধোঁয়া দিব।
মনোয়ারা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, মেয়েদের ঘরে ঢোকার সময় দরজা ধাক্কা দেবে, কেমন?
দেলোয়ার লজ্জায় প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে বলল, জ্বি আচ্ছা।
ধোঁয়া না দিলেও হবে। এরা শহরের মেয়ে, ধোঁয়া পছন্দ করবে না।
জি আচ্ছা।
শীতের মধ্যে পাতলা একটা শার্ট গায়ে দিয়ে মুরছ কেন? শীত লাগে না? তোমার গরম কাপড় আছে?
জ্বি।
গরম কিছু পরবে। তোমাকে দেখে তো আমারই শীত লাগছে। শোকে দেখেছ? শেফা কোথায়?
ছোট আপামণি পুকুরঘাটে।
আশ্চর্য তো, রাতের বেলা সে পুকুরঘাটে কী করে? ওকে ঘরে আসতে বল।
জি আচ্ছা চাচীজী।
দেলোয়ার মালশা নিয়ে অতি দ্রুত পুকুরঘাটের দিকে রওনা হল। মনোয়ারা রান্নাঘরের দিকে চললেন। তার রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। পুকুরঘাটের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে।
এই বাড়ির পুকুরঘাটটা মনোয়ারার খুব পছন্দ। ছোট্ট বাঁধানো ঘাট, যেন বাড়ির বৌ-ঝিদের জন্যেই করা হয়েছে। বারোয়ারি ব্যাপার না। বিশাল এক কামরাঙ্গা গাছ ঘাটের ওপর ছায়া ফেলেছে। মনোয়ারার ধারণা পৃথিবীর সবচে সুন্দর গাছ কামরাঙ্গা গাছ। কী অদ্ভুত তার চিরল চিরল পাতা।
শেফা চোখমুখ শক্ত-শক্ত করে ঘাটে বসে আছে। চোখমুখ শক্ত করার কারণ একটু আগেই সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। ভূতের ভয়। তার মন খুব খারাপ ছিল বলে সে একা-একা ঘাটে এসে বসেছিল। বলার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গা ছমছম করতে লাগল। মনে হল সে একা না, তার আশেপাশে আরো কেউ আছে। এক জন তো মনে হল ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে। সেই একজন অল্পবয়েসী একটা ঘোমটা-দেয়া বউ। তার শাড়ির শব্দ, হাতের চুরির শব্দ পর্যন্ত শেফা পেতে শুরু করল। মনে হচ্ছে এই মেয়েটার মতলব ভালো না, সে এসে শেফার পাশে বসবে। ঘোমটার ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকাবে এবং এক সময় হাত ধরে টানতে টানতে পানিতে নিয়ে যাবে। ঠিক এ-রকম একটা গল্প সে দেব সাহিত্য কুটিরের বইএ পড়েছিল। সেই গল্পেও গ্রামের পুকুরঘাট থেকে বাচ্চা একটা ছেলেকে ঘোমটা-পরা বউ ভুলিয়ে ভালিয়ে পানিতে নিয়ে ডুবিয়ে মারে।
শেফার বুক ধক করছে। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওপর তার প্রচণ্ড রাগও হচ্ছে কেন সে একা-একা ঘাটে এল কী দরকার ছিল। শেফার মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখনি মালশা হতে দেলোয়ার চলে চল। এত শাস্তি শেফা তার জীবনে পায় নি। ওঁ না, ভুল হয়েছে। এ-রকম শাস্তি শেফা। আরেকবার তার জীবনে পেয়েছিল। সেটা খুবই গোপন ব্যাপার কাউকে বলা যাবে না।
ছোট আপা, চাচীজী যেতে বলেছে।
শেফা পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুক।
দেলোয়ার বলল, একা একা বসে আছেন, ভয় লাগে না?
ভয় লাগবে কেন? একা একা বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে। দেলোয়ার ভাই, শুনুন। আপনাকে থ্যাংকস দেয়া হয়নি। মেনি থ্যাংকস। চশমার জন্যে।
দেলোয়ার হাসল। অন্ধকারে তার হাসি দেখা গেল না। দেলোয়ারের ধারণা সে তার জীবনে এমন সরল সাদাসিধা মেয়ে দেখেনি। আজ সকালে নৌকায় উঠতে গিয়ে মেয়েটার চোখ থেকে চশমা পরে গেল। মেয়েটা তা নিয়ে একটা শব্দ করল না। বোঝা যাচ্ছে সে তার বাবার ভয়ে চুপ করেছিল।
দুপুরবেলা দেলোয়ার নদীতে নেমে চশমা উদ্ধার করে। মেয়েটাকে চশমাটা দেয়ার পর সে চশমা রেখে পরতে পরতে বলে—আচ্ছা ঠিক আছে। যেন সে জানতই দেলোয়ার চশমা নিয়ে আসবে। চশমার জন্যে ধন্যবাদটা এই মেয়ে এখন দিচ্ছে।
দেলোয়ার ভাই।
জ্বি।
দুপুরবেলা আপনি যখন আমাকে চশমাটা দিলেন তখন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আপনি যে নদীতে চশমা পড়াটা লক্ষ্য করেছেন আমি বুঝতে পারি নি। আপনি বোধহয় আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারেননি যে আমি ভয়ংকর অবাক হয়েছি। বুঝতে পেরেছিলেন?
না।
আমার হচ্ছে স্টোন-ফেস। আমার চেহারা দেখে কেউ বুঝতে পারে না, আমি অবাক হচ্ছি না-কি দুঃখিত হচ্ছি। না-কি খুশি হচ্ছি। আমার ফেস এক্সপ্রেশন লেখ।