মনোয়ারা বললেন, তোমাকে খুবই জরুরি কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শোন।
আজহার সাহেব বললেন, জরুরি কথাটা পরে শুনি।
না পরে শুনবে না। এখনি শুনবে। তোমার বড় মেয়ের একটা ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠত হয়েছিল। মেয়ে এখন পেট বাধিয়ে ফেলেছে।
কী বলছ তুমি?
খুব খারাপভাবে বলছি। খারাপ জিনিস খারাপভাবেই বলতে হয়।
আজহার সাহেবের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মনোয়ারা তাঁর হাত ধরে টান দিয়ে আগের জায়গায় বসিয়ে কঠিন গলায় বললেন—কোনো চিৎকার করবে না। কোনো হৈ চৈ না। তারচে বড় কথা আমার মেয়েকে একটা কথা বলবে না। আমার মেয়ের সম্মান আছে। সে জলে ভেসে আসেনি।
সম্মান? তোমার মেয়ের সম্মান?
হ্যাঁ সম্মান। সে ভুল করেছে। এ যুগে মেলামেশার যে বাড়াবাড়ি তাতে ভুল হতেই পারে। এই ভুলের কারণে তার সম্মান সারাজীবনের জন্যে নষ্ট হবে কেন?
তুমি তাকে সাপোর্ট করছ? তুমি?
হ্যাঁ আমি। কারণ আমার কাজই হচ্ছে সাপোর্ট করা। তুমি যখন ভুল কর তখন ভুল জেনেও ভুলটাকে সাপোর্ট করি। করি না?
আমি ভুল করি?
অবশ্যই কর। তুমি ফেরেশতা না—মানুষ। এবং সাধারণ মানুষ। তুমি তো ভুল করবেই। এখন সেইসব নিয়ে কথা বলব না। এখন কথা বলব মীরার ভুল নিয়ে। তুমিতো জাজ সাহেব। মেয়ের বিচার কর।
মেয়ের বিচার করব?
হ্যাঁ মীরা ভার্সাস আজহার পরিবার, ফৌজদারি মামলা।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
হয়তো হয়েছে। মাথা খারাপ না হলে সত্যি কথা বলা যায় না। সত্যি যখন বলছি তখন মনে হয় মাথা খারাপই হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে এখন কী করবে বল।
ওকে এক্ষুনি বাড়ি থেকে চলে যেতে বল। এই মুহূর্তে। আমি যেন ওর মুখ না দেখি। আমি আর কোনো দিনও এই মেয়ের মুখ দেখতে চাই না।
খুব ভালো কথা। মেয়েকে ডেকে রায় শুনিয়ে দাও। আর দেলোয়ারকে বল তাকে যেন রেলস্টেশনে নিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়। সে কি এক বস্ত্র যাবে, না একটা স্যুটকে সঙ্গে নিতে পারবে?
আজহার সাহেব একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। তার হাত কাঁপছে। মনে হচ্ছে তিনি চোখেও ঝাপসা দেখছেন মনোয়ারার মুখ কেমন যেন অস্পষ্ট লাগছে।
মনোয়ারা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, যা করবে নিজের সম্মান বজায় রেখে করবে। লোকজন যেন কানাকানি করে। আচ্ছা শোন, মেয়েকে গলা টিপে মেরে দড়ি দিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দিলে কেমন হয়? আমরা আত্মহত্যা বলে প্রচার করে দেই। তোমার কি ধারণা এতে সব দিক রক্ষা হয়?
আজহার সাহেব আবারো উঠে দাঁড়াতে গেলেন, মনোয়ারা তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বললেন—না তুমি উঠবে না। তুমি জাজ সাহেব, রায় না দিয়ে আমি তোমাকে উঠতে দেব না।
আজহার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, তুমি যা ভালো বোঝ কর।
আমার উপর দায়িত্ব?
হ্যাঁ।
এই দায়িত্ব সবসময় মেয়েদেরই নিতে হবে কেন? ছেলেরা কেন নেবে না? ছেলেরা কি পৃথিবীতে এসেছে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানোর জন্যে?
আমাকে এইসব কেন বলছ?
জানি না কেন বলছি। আসলেই,তো তোমাকে না জানালেই হত। আনন্দের ব্যাপারগুলি তোমাকে জানানো যায়। সমস্যাগুলি কেন জানবে? মেয়েকে ক্লিনিকে নিয়ে ঝামেলা মুক্ত করে আনব, তুমি কিছুই জানবে না। তুমি কফি খেতে খেতে মেয়েদের সঙ্গে পাপ-খাদকের গল্প করবে। একসময় মেয়ের বিয়ে হবে। তুমি মেয়ে জামাইকে গ্রামের বাড়ি দেখাতে আনবে। তুমি তোমার এক জগতে কী সব মহৎ কর্ম করেই তা দেখাবে।
মনোয়ারা তুমি ঠিক করে বল। তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর।
তোমাকে ঘৃণা করি না আবার ভালো বাসি না।
ভালোবাস না?
না। এত অবাক হয়ে তাকাচ্ছ কেন? আমি যা করি তার নাম অভিনয়। ভালোবাসার অভিনয়। তুমিও তাই কর। আমাদের গাড়ি আমাদের বাড়ি এইসব বলে এমন ভাব করি যেন একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আসল ব্যাপার তা না। তুমি এখন যাও—তোমার পাথরের মতো মুখ দেখতে ভালো লাগছে না। তুমি গিয়ে রান্না-বান্নার জোগাড় দেখ। রাতে মাষ্টারসাহেবরা খাবেন। তাদের কী গল্প করবে তাও ঠিক করে রাখে। পাপ-খাদকদের গল্পটা আবারো করতে পার। অনেক গল্পের মধ্যে তোমার এই গল্পটা হল কুমিরের বাচ্চা। বার বার দেখানো যায়।
আজহার সাহেব ঘর থেকে বের হবার পর পরই মীরা পানির গ্লাস এবং চামচ নিয়ে ঢুকল। সে দেখল মা ঘুমিয়ে পরেছেন। সে মাকে জাগাল না। ঘর থেকে বের হয়ে এল।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
শেফা একা একা পুকুরপাড়ে বসে আছে। সে খুব ভয় পেয়েছে। একটু আগে সে ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখে এসেছে। দাদীজানের ঘরে বাবা বসে আছেন। বাবা হাউমাউ করে কাঁদছেন। দাদীজান বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এর মানে কী? কী হয়েছে? কাকে সে জিজ্ঞেস করবে। পুকুরপাড়ে সে কাদার জন্যে এসেছিল। এখন তার একটুও কান্না পাচ্ছে না। তার হাত পা কাঁপছে।
কামরাঙ্গা গাছ ভর্তি পাখি। বেশির ভাগই টিয়াপাখি। এরা চুপচাপ থাকে, হঠাৎ হঠাৎ সবাই একসঙ্গে ডেকে ওঠে এবং শেফা ভয়ংকর চমকে উঠে।
শেফার ভয়-ভয় করছে। সন্ধ্যাবেলা পুকুরপাড়ে একা একা থাকা ঠিক না। অশরীর। এই সময় নেমে আসে। কিন্তু শেফা কোথায় যাবে? মা শোবার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। মায়ের ভয়ংকর কিছু হয়েছে এটা সে বুঝতে পারছে। এই ভয়ংকর কিছুটা কী?
বড় আপারও ভয়ংকর কিছু হয়েছে। বড় আপা বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। তার চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। তার ঠোঁট কীভাবে যেন কেটেছে। মাছের ঠোঁট বঁড়শি লেগে যেভাবে কেটেছিল অবিকল সেইভাবে কেটেছে। সেই ঠোঁট ফুলে কী বিশ্রী হয়েছে। বড় আপা ঠোঁটে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কী অদ্ভুত ভাবেই না বসে আছে। শেফা দুবার সামনে দিয়ে হেটে গেল কিন্তু শেফা নিশ্চিত যে আপা তাকে দেখতে পায়নি।