দরজা ঠেলে শেফা ঢুকল। সে চিন্তিত মুখে বলল, মা তোমার কী হয়েছে?
শরীরটা খারাপ করেছে।
না জ্বর না। এম্নি শরীর খারাপ।
মাছটার ওজন কত জানো মা? সাত কেজি। দেলোয়ার ভাই দাঁড়িপাল্লা এনে মেপেছেন। পুরোপুরি সাত কেজ্বি না। সাত কেজির সামান্য কম। দুইশ গ্রাম বা ধরো দুইশ পঞ্চাশ গ্রাম।
আচ্ছা ঠিক আছে।
মাছটা আমি আর বাবা, আমরা দুজন মিলে রান্না করছি।
ভালো কথা, রান্না কর।
আপার সঙ্গে মাছ মীরা নিয়ে বাজি ছিল। আপা বাজির টাকা দিয়ে দিয়েছে। এক হাজার এক টাকা।
আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মনোয়ারা ক্লান্ত দায় এললেন, এই জীবনে আমি বেশির ভাগ কাজই তোমাকে খুশি করার হনে
আচ্ছা ঠিক আছে। এক মাছ নিয়ে আর কত কথা বলবে। আমি তো ঘরে পা দেবার পর থেকে শুনছি মাছ, মাছ, মাছ। মাছ ছাড়াও তো জগতে অনেক ব্যাপার আছে। আছে না? একটা কিছু মাধ্যায় ঢুকে গেলে ভাঙা রেকর্ডের মতো সেটাই বাজাতে হবে?
আই এ্যাম সরি।
সরি বলে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই, দয়া করে যাও। যেমন ভুতের মতো চেহারা তেমন ভূতের মতো আচরণ। মাছ, মাছ, মাছ। কান ঝালাপালা করে দিলে তো।
মা আমি তো বলেছি আই এম সরি। আর কখনো মাছ নিয়ে কথা বলব না।
বলবে না কেন? অবশ্যই বলবে। শুধু কথা বলা না, মাছ কোলে নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে থাক। রান্না করার কোনো দরকার লেখি না। যাও তোমার আপাকে আসতে বলো, একগ্লাস পানি আর একটা চামচ নিয়ে যেন আসে।
শেফা ঘর থেকে বের হয়ে এল। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে। তাকে অনেকক্ষণ কান্না চেপে রাখতে হবে। আপাকে খবর দিতে হবে, তারপর নির্জন কোনো জায়গায় গিয়ে কাঁদতে হবে। তার সব বন্ধুরাই খুব কান্না পেলে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কালে। সে তা পারে না। বাথরুমে সে যতবার কাঁদতে গেছে ততবার আয়নার দিকে চোখ পড়েছে। আয়নায় চোখ পড়তেই মনে হয়েছে অন্য আরেকটা মেয়ে তার কান্না দেখছে।
আজহার সাহেবের বানানো লেবুর শরবত মনোয়ারা সবটাই খেয়ে ফেললেন। স্বামীকে খুশি করার জন্য খাওয়া। দীর্ঘদিন এই জাতীয় কাজ করতে করতে ব্যাপারটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। চা খেতে ইচ্ছে করছে না—আজাহার সাহেব বললেন, খাও এককাপ চা। স্বামীকে খুশি করার জন্যে খেলেন। টিভিতে শুকনা ধরনের কোনো আলোচনা হচ্ছে। আজহার সাহেব বললেন, এই জন যাওতে। লোকটা তো ইন্টারেস্টিং কথা বলছে। দেশের ইকনমিক প্রবলেমটার মূল জায়গায় হাত দিয়েছে। এসে দেখে যাও। কুৎসিত সেই প্রোগ্রাম তিনি হাসিমুখে দেখেছেন।
শরবত খেতে ভালো না?
না ভালো না। তোমাকে খুশি করার জন্যে খেলাম।
আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মনোয়ারা ক্লান্ত গলায় বললেন, এই জীবনে আমি বেশির ভাগ কাজই তোমাকে খুশি করার জন্যে করেছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। তোমার পছন্দকে আমি নিজের পছন্দ করে নিয়েছি। আমার কষ্ট হয়েছে কিন্তু করেছি।
আজহার সাহেবের বিষয় আরো বাড়ল। মনোয়ারার কথার ধরন তিনি বুঝতে পারছেন না। তার কী হয়েছে?
মনোয়ারা বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস।
আজহার শাহেব বললেন। মীরা গ্লাস-ভর্তি পানি এবং চামচ নিয়ে উঁকি দিল। মনোয়ালা বললেন, তুই একটু পরে আয়। আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলছি।
আজহার সাহেব বললেন, কথা বলার দরকার নেই তুমি রেস্ট নাও।
রেস্ট তো নেবই। কথা বলতে ইচ্ছা করছে, কথা বলে নেই। আমার যখন। তোমার কথা শুনতে ইচ্ছা করে না তখনো তো কথা শুনি। খুব মন দিয়ে শুনি। যেখানে হাসার কথা সেখানে হাসি। যেখানে দুঃখিত হবার দরকার সেখানে দুঃখিত হই।
হঠাৎ এইসব কী ধরনের কথা শুরু করলে?
তোমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার একেবারেই আসতে ইচ্ছা করছিল না। বড় আপার ছেলেটা চিকিৎসার জন্যে বাইরে যাবে। সে মনে হয় বাঁচবে না। আমি চেয়েছিলাম কয়েকটা দিন বড় আপার কাছে থাকতে। কিন্তু তা করিনি। তোমাকে খুশি করার জন্যে গ্রামে এসেছি। হৈ চৈ করছি। মজা করছি।
আমাকে বললেই তো হত।
বলেছিলাম। তুমি মুখে হ্যাঁ না কিছুই বলনি, কিন্তু খুব বিরক্ত হয়েছিলে। কাজেই আমি হাসিমুখে তোমার সঙ্গে এসেছি। কেন জানো?
কেন?
সংসারটাকে ঠিক রাখার জন্যে, সুন্দর রাখার জন্যে। যেন যেই দেখে সেই ভাবে—আহা এরা কী সুখেই না আছে! বড় আপা যতবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে ততবারই বলে—মনোয়া আমি তোর কাছে আসি সুখ দেখার জানে। তোর সুখ দেখে মন ভরে যায়।
সুখ দেখে কেউ যদি খুশি হয় সেটা কি দোষের?
না দোষের না। আনন্দের।
সংসারটা সুখের করার চেষ্টাটা কি দোষের?
না দোষের হবে কেন? তবে মেকি চেষ্টাটা দোষের।
আজহার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তোমার চেষ্টা মেকি?
শুধু আমার না। আমাদের সবার চেষ্টাই মেকি।
মনোয়ারা তোমাকে একটা কথা বলি। যে-কোনো কারণেই হোক আজ তুমি উত্তেজিত। উত্তেজিত অবস্থায় তুমি কী বলছ না বলছ নিজেই জানো না।
জানব না কেন? খুবই জানি। তবে আমি উত্তেজিত না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছি।
সব কথা আই বলতে হবে কেন?
আজই বলতে হবে কারণ সুখী-সুখী খেলা আর আমার ভালো লাগছে না।
আজহার সাহেব একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। মনোয়ারার চোখের লাল ভাব আরো বেড়েছে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আসলে মনোয়ারা কাঁদছেন। কান্নাটাকে কান্না মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে চোখের কোনো