বেহুলার চেয়ে সে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বেহুলা তার কালরাতের খবর আগেভাগে জানত না। সে জানে। না, ভুল ভাবা হচ্ছে। বেহুল। জানত তার মহাবিপদের কথা। সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে লোহার বাসর-ঘর করেছিল। তাতে লাভ হয়নি। চুলের মতো কালনাগিনী কোন এক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল।
মীরা তার কালরাতের জন্যে যত প্রস্তুতিই নিক, কোনো এক ফাঁকফোকর দিয়ে কালনাগিনী ঢুকে পড়বে। নিয়তি এড়ানো যাবে না। নিয়তি মেনে নিতে পারলে খুব ভালো হত। সব দায়দায়িত্ব নিয়তির হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ানো যেত। মুশকিল হচ্ছে নিয়তির হাতে মীরা নিজেকে ছাড়তে পারছে না। নিয়তি বেহুলার জন্যে সত্যি, তার জন্যে সত্যি না।
গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল। ঘুম ভেঙে মনোয়ারা অসহায় গলায় বললেন, কী হয়েছেরে মীরা?
ড্রাইভার বলল, কিছু না আম্মা। চাকা পাংচার। রাস্তা এমুন জঘন্য।
মনোয়ারা বললেন, চাকা বদলাতে কতক্ষণ লাগবে?
দশ মিনিট।
তাড়াতাড়ি বদলাও। আমাদের বাড়িতে রেখে তুমি ঢাকা যাবে।
ড্রাইভার জবাব দিল না। সে গাড়ি থেকে নেমে চাকা বদলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেলোয়ার তার পাশে। দেলোয়ারের হাতে এখনো পানি-ভর্তি জেরিকেন। সে মনে হয় কোনো অবস্থাতেই এটা হাতছাড়া করবে না।
মীরা বলল, মা তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে। জানালার কাচ পুরোপুরি উঠিয়ে দেব?
মনোয়ারা বললেন, আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজের কথা ভাব।
মনোয়ারা আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মীরা গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল। মীরা নিজেকে নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু ভাবতে চাচ্ছে না। আগেভাগে ভেবে কিছু হবে না। সময় হোক। শুধু একটা ব্যাপার ঠিক রাখতে হবে—সে কী করবে?
এটা ঠিক করা আছে। এ নিয়ে অরি ভাবাভাবির কিছু নেই। সাবেব নামের মানুষটাকে সে বিয়ে করবে না। এবং…
নাহ এবং কী তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না। বাবার সঙ্গে মীরার কথা বলা দরকার। বাবাকে ও খোলাখুলি সব জানানো দরকার। তিনি মনে কত টু। কষ্ট পাবেন বা না পাবেন তা নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই। মীরাকে দেখতে হবে তার নিজের জীবন।
বাবাকে কথাগুলি কীভাবে বলা যায়? কথাগুলি ইংরেজিতে শুরু করা যেতে পারে। ইংরেজিতে বলার একটা সুবিধা হচ্ছে, মনে হয় সে তার নিজের সমস্যার কথা বলছে না। অন্য কারো সমস্যার কথা বলছে।
বাবা, I want to discuss something with you. Please spare me few minutes.
না ভালো লাগছে না। কথাগুলি বাংলাতেই বলতে হবে।
বাবা আমি একটা ভয়ংকর বড় ভুল করেছি। ভুল যখন করেছি তখন আমার কাছে ভুল মনে হয়নি এবং এখনো মনে হচ্ছে না। তবে ভুলতো বট্রেই। এই ভুলের জন্যে তোমব্রা আমাকে শাস্তি দিতে চাও দাও। কিন্তু আমার জীবনটা যেহেতু আমার, আমি সেই জীবন কীভাবে যাপন করব তা ঠিকও করব আমি। এই ব্যাপারে তোমরা জোর খাটাতে পারবে না।
বাবা তখন নিশ্চয়ই খুবই বিস্মিত হয়ে বলবেন—এ-রকম বক্তৃতার ভাষায় কথা বলছিস কেন রে? ব্যাপারটা কী?
ব্যাপারটা শোনার পর বাবা কীভাবে রি এক্ট করবেন? আগেভাগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। মা এত কাছের, সেই মা যে এমন করবে তাতো মীরা বুঝতে পারে নি। মীরার আশা ছিল— আর কেউ না হোক, মা অন্তত তার সমস্যা কিছুটা হলেও মীরার মতো করে দেখবে। মা শুধু মা না, একই সঙ্গে মেয়ে। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের জন্যে কোনোরকম সহানুভুতি বোধ করবে না?
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মনোয়ারা জেগে উঠেছেন। তার চোখ এখনো লাল। কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছেন বলে লাল ভাব আরো বেড়েছে।
মীরা বলল, মা তোমার শরীরটা একটু ভালো লাগছে?
মনোয়ারা জবাব দিলেন না এবং মেয়ের দিকে ফিরলেনও না। তিনি তাকিয়ে আছেন তার ডানদিকে। দৃষ্টি জানালার বাইরে–ফসল কাটা খেলা প্রান্তর। দেখার কিছু নেই।
মীরা বলল, মা একটা ক্যাসেট চুললে তোমার কি খুব অসুবিধা হবে।
মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকালেন। তার চোখে বিস্ময়। এমন একটা ভয়ংকর সময়ে মেয়েটা ক্যাসেটে গান দিতে চাচ্ছে। তার মানে কি এই যে ভয়ংকর ব্যাপারটা তার গায়ে লাগছে ন!! সে কিছু বুঝতেই পারছে না। তার ধারণা ছিল তিনি তার পরিবারের মানুষগুলিকে চেনেন। এখন মনে হচ্ছে চেনেন না।
ড্রাইভার গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে ক্যাসেট বের করে চালিয়ে দিল। গান হচ্ছে। মীরা চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে। ফুলের সঙ্গে এই মেয়ের উপমা দেয়া ঠিক হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপারে মনোয়ারা খুব অবাক হচ্ছেন—গান শুনতে তার নিজেরো ভালো লাগছে। শুধু ভালো না, বেশ ভালো লাগছে। তিনি নিজেও চোখ বন্ধ করলেন। গান হচ্ছে। যে গাইছে তার গলাটাও তো খুব মিষ্টি। বন্যা না-কি? মনোয়ারার ইচ্ছা করছে মীরার কাছে নামটা জানতে। তিনি অবশি। জানতে চাইলেন না। চোখ বন্ধ করলেন।
হেথা যে গান গাইতে আসি। আমার
হয়নি সে গান গাওয়া।
আজো কেবলি সুর সাধা, আমার
কেবল গাইতে চাওয়া।
শেফা ভেবে পাচ্ছে না কেন তার ভাগ্যটা এত খারাপ? পৃথিবীতে নিশ্চয়ই তারচে অনেক খারাপ ভাগ্যের মেয়ে আছে তবে শেফার ধারণা বাংলাদেশে তারচে খারাপ ভাগ্যের মেয়ে আর নেই।
আজ সে এতবড় একটা মাছ ধরে ফেলেছে। আর আজই কি-না বাড়িতে। কেউ নেই। সে, বাবা আর দাদীজান। দাদীজানের সকাল থেকে দাতব্যথা বলে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তারপরও তিনি এসে দেখেছেন এবং শেফাকে হতভম্ব করে বলেছেন—মাছটা তো খারাপ না।