শেফা কাপতে কাপতে বঁড়শি ধরল। আর তখন অন্য ফাৎনাটা ও পানিতে ডুবে গেল। শেফা কী করবে। মাছ-মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দেবে কী করে? তার হাত বন্ধ। মাছ সুতা টানছে। শিশিশি শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাছটার ভয়ংকর শক্তি। ছিপ ধরে বসে থাকা যাচ্ছে না। রাক্ষুসী মাছ নাতো? মানুষ গিলে খেয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো রাক্ষসী মাছ! পুরানো দিঘিতে এ-রকম মাছ থাকতেও তো পারে। পানির অনেক নিচে এরা মাটির মাছ উপর শুয়ে থাকে। এদের একেকটার বয়স দুশ তিনশ বছর। এদের হা প্রকাণ্ড। শরীর লোহার মতো শক্ত। এরা প্রচণ্ড রাগী। বেশিরভাগ সময় এরা ঘুমিয়ে থাকে। যে তাদের ঘুম ভাঙায় তাকে তারা কিছুতেই ক্ষমা করে না।
নানান ফন্দি-ফিকির করে এরা তাকে পানিতে নিয়ে যায়। তারপর খুবলে খুবলে চোখ খেয়ে ফেলে। এইসব কথা শেফাকে কেউ বলেনি। তার মনে হচ্ছে।
হুইলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শেফার স্ত্রীর কাঁপছে। বুক ধক ধক করছে। আর কিছুক্ষণ এ-রকম চললে শেফা মনে হয় টেনশানে মরেই যাবে। এমন অবস্থায় হঠাৎ সুতা টানা বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। পৃথিবী যেন হঠাৎ শব্দহীন হয়ে গেল। আশ্চর্য গাছের পাতাও পড়ছে না।
এ-রকম কীভাবে হয়। পৃথিবী এমন শব্দহীন হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। ভৌতিক কিছু।
শেফা কাঁদো-কাঁদো গলায় ডাকল, বাবা।
শেফাকে ভীষণ চমকে দিয়ে শেয়ার ঠিক পেছন থেকে আজহার সাহেব বললেন, কী হয়েছে মা?
মাছ টোপ খেয়েছে।
মাছ টোপ খেয়েছে খুব ভালো কথা। তুই এমন ছটফট করছিস কেন?
কেমন জানি লাগছে।
কেমন লাগালাগির কিছু নেই। মাছটা এখন খেলিয়ে তুলতে হবে। সুতা ছাড়তে হবে। দেখি ছিপটা আমার হাতে।
তা না তোমার হাতে দেব না। তুমি আমাকে বলে দাও কী করতে হবে। যা করতে বলবে তাই করব। সুতা কীভাবে ছাড়তে হয়?
শেফার কথা শেষ হবার আগেই মাছ আবার সুতা টালা শুরু করল এবং প্রথমবারের মতো তাকে দেখাও গেল। সে পানি ছেড়ে শুন্যে লাফিয়ে উঠল।
আজাহার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, একি! এ তো বিরাট মাছ! এই মাছ ধরে রাখা তোর-আমার কর্ম না। এক্ষুনি সুতা ছিঁড়ে ফেলবে।
শেফা বলল, তুমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না বাবা। আমাকে কী করতে হবে বল।
কী করতে হবে আমি নিজেও তো জানি না।
শেফা ছিপ ধরে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে তাকে-সুদ্ধ টেনে পানিতে ফেলে দেবে। আজহার সাহেব মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। উত্তেজনায় তার ও শরীর কাঁপছে। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, যেভাবেই হোক মাছটাকে খেলিয়ে ডাঙায় তুলতে হবে। আরো সুতা ছাড়তে হবে।
শেফা বলল, আর কীভাবে সুতা ছাড়ব?। ৷ আজহার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আমি নিজেওতো মা তোর মতই আনাড়ি। অবশ্যি আমার নিজেকে ওল্ড ম্যান দ্য সির ফিসারম্যানের মতো। লাগছে। ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি পড়েছিস?
এই সময় পড়াশোনার কথা বলবে নাতো বাবা, ভালো লাগছে না।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা অসাধারণ উপন্যাস।
বাবা তুমি সবসময় বিরক্ত কর কেন?
নোবেল প্রাইজ পাওয়া উপন্যাস।
বাবা প্লিজ।
শেফা আমি এক কাজ করি। আমি বরং পুকুরে নেমে পড়ি। আমি দেখেছি ছিপে বড় মাছ ধরা পড়লে এক জন পুকুরে নামে।
তাহলে তুমি নেমে পড়। কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন?
তুই ছিপ শক্ত করে ধরে থাক।
আমি ধরে আছি।
আজহার সাহেবের গায়ে শীতের কাপড়। কাশ্মিরি কাজ-করা লাল সোয়েটার।
তিনি সেই কাপড়েই পানিতে নেমে পড়লেন।
মনোয়ারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। গাড়ির সীটে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছেন। তার মাথায় সবসময় ঘোমটা দেয়া থাকে, এখন ঘোমটা নেই। শাড়ির আচল সরে গেছে। জানালা খানিকটা খোলা। শীতের বাতাসে তার মাথায় কাঁচাপাকা চুল উড়ছে। মীরার মনে হল জানালাটা বন্ধ করা দরকার। মার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আবার মনে হচ্ছে এই ভালো, বন্ধ বাতাসে না-থেকে খোলা বাতাসে থাকাই ভালো। ঘুম ভালো হবে। মার ঘুম দরকার। আজ রাতেও মা নিশ্চয়ই ঘুমুবে না। সারারাত জেগে থাকবে। এবং তার শরীর ভয়ংকর খারাপ করবে।
মীরা মার একটা ব্যাপারে মুগ্ধ। সে কখনো চিন্তাও করেনি তার মা এই ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে এবং এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে। পরিস্থিতি মানুষকে তৈরী করে। কথাটা বোধহয় ঠিক। পরিস্থিতি যখন পাল্টে যায় তখন মানুষ পাল্টে যায়। মুরগি জবে করার দৃশ্য দেখে যে মানুষ ভয়ে ভিরমি খায় সে-ই ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে। তখন তার হাত কাঁপে না। মানুষ জলের মতো। পাত্রের সঙ্গে সঙ্গে সে তার আকার বদলায়।
বাড়ির পরিস্থিতি বদলে গেছে, মা বদলে গেছেন। বাবা নতুন পরিস্থিতির খবর জানেনও না। তিনি যখন জানবেন তিনি বদলে যাবেন। শেফা বদলাবে। দেলোয়ার বদলাবে। এখন দেলোয়ার ভীত মুখে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। তার কোলে পানিভর্তি জেরিকেন। এক-একবার গাড়ি ঝাঁকুনি খাচ্ছে জেরিকেনের পানি তার গায়ে পড়ছে। সে নির্বিকার। দেলোয়ার পানি সঙ্গে নিয়েছে যদি যাবার পথে ও চাচাজী বমি করেন। পানির অভাবে যেন তার অসুবিধা না হয়। দেলোয়ার একটু পরপর ঘাড় ঘুরিয়ে মনোয়ারাকে দেখছে। মীরার মনে হল দেলোয়ার বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে কী যেন বলছে। জানতে ইচ্ছা করছে। পরিস্থিতি আগের মতো থাকলে সে জিজ্ঞেস করত, দেলোয়ার সাহেব বিড়বিড় করছেন কেন?
আচ্ছা এই মানুষটাকে সে দেলোয়ার সাহেব ডাকে, না দেলোয়ার ভাই ডাকে? আশ্চর্য, মনে পড়ছে না। তার নিজের মাথাও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মাথা এলোমেলো হতে দেয়া যাবে না। খুব ভয়াবহ সময় তার সামনে। সবচে ভয়ংকর সম্ভবত আজ রাতটাই। এই রাত পার করতে পারলে বাকি জীবন সুখে-দুঃখে কেটে যাবে। আজ রাত তার জন্যে কালরাত। সব মানুষের জীবনে একটা কালরাত থাকে। লখিন্দরকে যে রাতে সাপে কাটল সে রাতটা ছিল বেহুলার কালরাত।