কখন সে বাসায় থাকে, কখন থাকে না—সব তোর মুখস্থ। মীরা শোন তাকে যদি টেলিফোনে না-পাওয়া যায় তাহলে তোকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব।
আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে?
হ্যাঁ ঢাকায় যাব। দেলোয়ারকে দিয়ে তোর বাবার কাছে চিঠি লিখে যাব যে আমার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছে। ডাক্তার আমাকে এক্ষুনি ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছে বলে তুই আমাকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিস। তোর বাবা দুশ্চিন্তা করবে—করুক দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তার সে দেখেছে কী? দুশ্চিন্তার তো সবে শুরু।
মা যে এই কাজটা করবে তা মীরা বুঝতে পারছে। মা গাড়ি নিয়ে বের হবার সময়ই তৈরী হয়ে এসেছে।
মীরা বলল মা তোমাকে একটা কথা বলি।
বল।
তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমার ভয় লাগছে। তুমি একা টেনশানটা নিতে পারছ না। তুমি এক কাজ কর, বাবাকে সব জানাও। যা করার বাবা করুক।
তুই আমাকে উপদেশ দিবি না। তোর উপদেশগুলি তুই নিজের জন্যে জমা করে রাখ। তোর বাবাকে আমি কিছুই জানাব না। তোকে বিষ খাইয়ে যদি মেরেও ফেলতে হয় তাও জানাব না। মরা মেয়ের জন্যে সে কষ্ট পেলে পাবে— তুই যে কাণ্ড করেছিস সেই ঘটনা জানার কষ্ট আমি তাকে দেব না।
মা বলল, মা তোমাকে সরল সাদাসি বা মেয়ে জানতাম। তুমি মোটেই তা না। তুমি ভয়ংকর একটা মানুষ।
মনোয়ারা শান্ত গলায় বললেন, আমি যে কত ভয়ংকর সেই সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাও নেই।
একটা কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ না। আমি তোমার মেয়ে। আমিও কিন্তু ভয়ংকর। কে জানে হয়তোবা তোমার চেয়েও ভয়ংকর।
ড্রাইভার এবং দেলোয়ার ফিরে এসেছে। দেলোয়ারের হাতে কালো পলিথিনের একটা প্যাকেট মনোয়ারা বললেন, পেয়েছ?
দেলোয়ার ভীত স্বরে বলল, জ্বি।
ক প্যাকেট এলেছ?
চার প্যাকেট। চার প্যাকেট কিনলে পাইকারি রেট দেয়।
ভালো করেছ।
চাচীজীকে তার খুবই ভয় লাগছে। চাচীজীর উপর জ্বিনের আছর হয়নি তো। হবিব নামে যে জ্বিনটা এ বাড়িতে থাকে সে বড়ই দুষ্ট।
মনোয়ারা বললেন, মোতালেবকে চা খাইয়েছ?
দেলোয়ার জবাব দেবার আগেই মোতালেব বলল, জি আম্মা।
ঘুম কেটেছে ?
জ্বি।
মোতালেব শোনা। আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে। আমাকে ঢাকা যেতে হতে পারে। গাড়ির চাকা টাকা সব ঠিক আছে?
স্পেয়ার চাকা লিক আছে।
আমরা টেলিফোন করার ফাঁকে গাড়ির যা ঠিকঠাক করার করে নাও।
জ্বি আচ্ছা।
আই এস ডি লাইন হওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছে। তিন বারের চেষ্টাতেই লাইন পাওয়া গেল। টেলিফোন ধরল সাবের। মীরার কথা ঠিক হয়নি। সাবের বাসাতেই ছিল। মীরা টেলিফোন রিসিভার মার দিকে বাড়িয়ে দিল। মনোয়ারা সহজ ভঙ্গিতে ব্রিসিভার হাতে নিলেন। মফস্বলের টেলিফোন অফিস কখনো নিরিবিলি থাকে না। এখানেও নেই। ছোট্ট একটা ঘরের একদিকে মীরা এবং মনোয়ারা—অন্যদিকে টেবিল চেয়ার পেতে এক বুড়ো ভদ্রলোক বসে আছেন। মাথা নিচু করে যাইলে কী সব লিখছেন।
মীরা নিচু গলায় বলল, মা আমি কি উনাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য ঘরে যেতে বলব?
মনোয়ারা বললেন, না কিছু বলতে হবে না।
ওপাশ থেকে সাবের বলল, হ্যালো হ্যালো। কে কথা বলছেন?
মনোয়ারা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, কে সাবের?
জ্বি।
আমি মীরার মা কথা বলছি।
স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম, তুমি ভালো আছ?
জ্বি ভালো।
এদিকে মীরার শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে, প্রচণ্ড জ্বর। কথা ছিল নেত্রকোনায় এসে সে তোমার সঙ্গে কথা বলবে। জ্বরের জন্যে আসতে পারেনি বলেই আমি কথা বলছি।
জ্বি বলুন।
তুমি কি একটু আসতে পারবে?
কোথায়?
মীরার গ্রামের বাড়ি। বেড়ানোর জন্যে জায়গাটা খুব সুন্দর, তোমার পছন্দ হবে।
জ্বি না। ঢাকায় আমার অনেক কাজ।
মীরা বলছিল তোমার সঙ্গে তার কিছু জরুরি কথা আছে।
ঢাকায় যখন আসবে তখন কথা বলব।
মীরাকে দেখে মনে হয় সে কোনো ভয়াবহ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
সমস্যাটা কী তা কি তুমি জানো?
আমি জানি না।
তুমি জানো না, নাকি জেনেও দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাচ্ছ?
আপনি কী বলছেন আমি বুঝতেই পারছি না।
তুমি বুঝতেই পারছ না?
জ্বি না। তা ছাড়া লাইনে ডিস্টার্ব হচ্ছে। কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না।
আমি অবশ্য তোমার কথা পরিষ্কার শুনতে পারছি। যাই হোক আমি কিছু কথা তোমাকে বলছি তুমি মন দিয়ে শোন। আমি তোমার জন্যে গাড়ি পাঠাচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি পৌঁছে যাবে।
হ্যালো শুনুন। গাড়িটাড়ি পাঠাবেন না। বিকাল সাড়ে তিনটার সময় আমি দেশে চলে যাচ্ছি। আমার মা খুব অসুস্থ। মাকে দেখতে যাব।
আমি আমার কথা শেষ করে নেই তারপর তুমি যদি অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে চাও দেখতে যাবে। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়াই তো উচিত। আমি কী বলছি মন দিয়ে শো। সন্ধ্যার মধ্যে তোমার কাছে গাড়ি যাবে। তুমি গাড়িতে করে চলে এসো। তুমি যদি সঙ্গে কোনো বন্ধু-বান্ধব আনতে চাও তাদেরও নিয়ে এলো ..
আমি শুধু শুধু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গ্রামে আসব কেন?
আমি মনে করছি তোমার এখানে আসা দরকার। এখানে এলে মঙ্গল ছাড়া তোমার কোনো অমঙ্গল হবে না। না এলেই বরং অমঙ্গলের সম্ভাবনী।
আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
শুধু শুধু তোমাকে কেন ভয় দেখব। যারা ভয় পাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে তারা সবকিছুতেই ভয় পায়। দড়ি দেখলে ভাবে সাপ। সুতা দেখলে ভাবে সুতা সাপ। তবে বাবা শোন, তোমাকে ভয় দেখাতে চাইলে আমি অবশ্যই ভয় দেখাতে পারি। আমি যদি চাই রাত আটটার মধ্যে তুমি এখানে উপস্থিত থাকবে—তোমাকে থাকতেই হবে। তুমি মীরার সরলতা দেখবে, তার ক্ষমতা দেখবে না, তাতো হবে না।