মা আমাকে মারলে কেন?
তুমি এমন কিছু করনি যে তোমার গালে চুমু খেতে হবে।
আমাকে মারতে হবে এমন কিছুও আমি করিনি।
মনোয়ারা মেয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়লেন। মীরা মাকে নিয়ে খাটের উপর পড়ে গেল। খাটের কোনা লেগে মীরার ঠেটি কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। মীরা হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে আছে। মীরা খুবই অবাক হয়ে বলল, মা তুমি আমাকে মারছ?
হ্যাঁ মারছি। আমি তোকে খুন করে ফেলব।
বেশতো খুন কর। খুন করে ডেডবডি বস্তায় ভরে পুকুরে পানিতে ডুবিয়ে দাও।
একটা কথা না। তুই আমার সঙ্গে আয়। এখন থেকে আমি যা বলব তাই করবি।
মীরা শোবার ঘর থেকে মার পেছনে পেছনে বারান্দায় এল। বারান্দায় দেলোয়ার ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে মীরার দিকে একবার তাকিয়েই চট করে চোখ নামিয়ে নিল। মনোয়ারা হিংস্র ভঙ্গিতে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চাও?
দেলোয়ার ক্ষীণস্বরে বলল, কিছু চাইনা চাচীজী।
ড্রাইভারকে বল, আমি নেত্রকোনা যাব।
চাচীজী আমি সাথে যাব?
হ্যাঁ তুমি সঙ্গে যাবে।
দেলোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। বড় আপার ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খয়েরি শাড়িতে রক্তের দাগ ভরে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। এই তথ্যটা ড্রাচীজীকে জানানো দরকার কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছে না।
মনোয়ারা বললেন, বাড়িয়ে আছ কেন? কথা কী বলছি কানে যাচ্ছে না?
দেলোয়ার ছুটে বের হয়ে গেল।
মীরা বলল, মা তুমি পাগলের মতো আচরণ করছ। পাগলের মতো আচরণ করতে হলে আমি করব। তুমি করছ কেন? আমি তো স্বাভাবিক আছি।
তুই স্বাভাবিক আছিস কারণ তুই কী করেছিস বুঝতে পারছিল না। বুঝতে পারলে পুকুরে ঝাপ দিয়ে পড়তি।
তুমি কি চাও আমি পুকুরে ঝাপ দেই? বল তুমি চাও?
গলা উঁচু করে কথা বলবি না। খবরদার গলা উঁচু করবি না। কেউ যেন কিছু না জানে।
মা তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।
আমার মাথা ঠিক আছে। কতটা ঠিক আছে জানতে চাস? প্রয়োজনে আমি নিজের হাতে ইঁদুর-মীরা বিষ হলে তোকে খাওয়া। আমার হাত কাপবে না। যা ঘরে যা, কাপড় বদলে আয়।
মীরা ঘরে নিল। মনোয়ারা মেয়ের পেছনে পেছনে ঢুকলেন। তাকে হিংস্র লাগছে। তার ঠোঁটে কেনা জমে আছে। মার দিকে তাকিয়ে মীরার বুক কাপতে লাগল। এই মাকে সে চেনে না। এই মা তাকে সত্যি সত্যি ইঁদুর-মীরা বিষ কিনে খাওয়াতে পারে।
গাড়িতে মনোয়ারা সারাপথ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। তাঁর নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। বমি ভাব হচ্ছে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে ব্রাত্রায় নেমে তিনি বমি করলেন। সঙ্গে পানি আনা হয়নি। কুলি করা হল না। মুখ ধোয়া হল না।
দেলোয়ার একবার বলল, চাচী জী দৌড় দিয়া পানি নিয়া আসি।
মনোয়ারা বললেন, কিচ্ছ আনতে হবে না।
তিনি রাস্তার পাশের ডোবার কাছে নেমে গেলেন। ডোবার নোংরা পানি মুখে দিলেন। মাথায় দিলেন। ড্রাইভার এবং দেলোয়ার দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
মা দেলোয়ারকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে। মীরাও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। সে একবার শুধু বলল, মা তোমার শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে? মনোয়ারা মেয়ের দিকে তার দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু বললেন না। মীরা লক্ষ্য করল তার মার চোখ লাল হয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার সময় চোখ লাল ছিল না। এখন চোখ লাল। চিলা গাড়িতে উঠে মনোয়ারা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। দেলোয়ারের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। নানান ধরনের কথা। এখানকার এম, পি, কেমন এম. পি., রাস্তাঘাটের এই অবস্থা ঠিক করছে না। বর্ষাকালে মাঠগুলি কি পানিতে ডুবে যায়? এখানে হাটুবার কবে? পরের হাটে দেলোয়ার যেন খুঁজে দেখে ভেড়া পাওয়া যায় কি-না। তার ছোটবেলা থেকে শখ তিন-চারটা বাচ্চাওয়ালা একটা মা ভেড়ার।
নেত্রকোনা শহরে পৌঁছেই তিনি দেলোয়ারকে বললেন, বাবা তুমি আমাকে আগে একটা টেলিফোন করার ব্যবস্থা করে দাও। কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করব আর এই ফাঁকে তুমি ভালো দেখে দুই কেজি খাশির গোশত কিনবে। সিনা আর রান মিলিয়ে কিনবে। যদি টক দৈ পাওস্লা যায় তাহলে এক হাঁড়ি টক দৈ কিনবে। টক দৈ না পাওয়া গেলে এক বোতল ভিনিগার। ভিনিগার কী জানো তো? সিরকা। এর সঙ্গে অবশ্যই তুমি ইঁদুর মারার যে অষুধ আছে ব্যাটম! র্যাটম কিনবে। ইঁদুর মারার অষুধ পাওয়া যায় না?
দেলোয়ার বলল, জ্বি পাওয়া যায়।
দু প্যাকেট র্যাটম কিনবে। ঘরে খুব ইঁদুরের উপদ্রব। ব্রাতে এরা বড় যন্ত্রণা করে। এক ক জ কর। আমরা গাড়িতে বসছি, তুমি আগে র্যাটম নিয়ে এসো তারপর টেলিফোন করতে যাব। ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তাকে এককাপ চা খাইয়ে আনো। সারা রাস্তা ঝিমুচ্ছিল।
দেলোয়ার ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেল। মনোয়ার আগের মতো সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পরে আছেন। তার বুকের ব্যথাটা বেড়েছে।
মীরা মার কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝতে পারছে না। মা এমন করছে কেন? তাকে কি ব্রাটম দিয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে? ভয় দেখাবার কিছু কি আর এখন আছে? টেলিফোনে মা কী বলবে তাও সে বুঝতে পারছে না। মার যা অবস্থা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটা কথাও তো বলতে পারার কথা না। মীরা লক্ষ্য করল তার মার চোখ এখন আরো লাল হয়েছে। মনে হচ্ছে তার চোখ উঠেছে।
মীরা বলল, মা তুমি আমাকে এখানে আসতে বলছ আমি এসেছি। তুমি টেলিফোন করতে চাচ্ছ, কর। তুমি টেলিফোনে তাকে পাবে না।
পাব না কেন?
এখন প্রায় একটা বাজে। এই সময় সে বাসায় থাকে না। টেলিফোনটা উত্তরার বাসায়।