আজহার সাহেব পুরানো কথা ভেবে আবারো রোমাঞ্চিত হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মীরা তোর জন্মের সময়ের ঘটনা মনে আছে? সিরিয়াস কাণ্ড।
মীরা বলল, প্লিজ বাবা সিরিয়াস কাণ্ডের গল্প এখন শুরু না করলে ভালো হয়। কতবার যে শুনেছি। মাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হলি ফ্যামিলিতে, তুমি উপস্থিত হয়েছ ঢাকা মেডিকেলে।
মীরা উঠে দাঁড়াল। আজহার সাহেব বললেন, উঠছিস কেন বোস না গল্প করি।
উহুঁ। তোমার ভাবভঙ্গি ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তুমি বাসি গল্প শুরু করবে।
তোর মাকে পাঠিয়ে দে।
মীরা চলে যাচ্ছে। আজহার সাহেব মমতা নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরানো দিনের কথা মনে হয়ে তার ভালো লাগছে। Old is gold. অতীতের গল্প হিরন্ময়। মনে করলেই ভালো লাগে। তিনি শেষ পর্যন্ত ঠিক হাসপাতালে পৌঁছলেন রাত আটটা বেজে দশ মিনিটে। লজ্জিত ভঙ্গিতে ন নম্বর কেবিনে ঢুকলেন। কেন দেরি হল মনোয়ারা বলতে যাবেন তার আগেই তোয়ালে দিয়ে জড়ানো মীরাকে নার্স তার কোলে তুলে দিতে দিতে বলল, আপনার প্রথম সন্তান মেয়ে, আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান। আর দেখুন কী টুকটুকে মেয়ে।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে গভীর আনন্দে আজহার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। খুবই অস্বস্তির ব্যাপার, তার কোলে মেয়ে। দুটা হাতই বন্ধ। এদিকে চোখে পানি। হাত দিয়ে যে চট করে চোখের পানি মুছে ফেলবেন সে উপায় নেই। নার্স তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।
মনোয়ারা শোবার ঘরের খাটে বসে আছেন। সারারাত তার একফোঁটা ঘুম হয়নি। ঘুমের চেষ্টাও করেননি। মীরা ঘুমিয়েছে, তিনি তার পাশে জেগে বসেছিলেন। শেষরাতে বিছানা থেকে নামলেন। বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে রইলেন। যখন আকাশে আলোর আভা দেখা গেল তখন তার মনে হল, তিনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। মীরা তার সঙ্গে রসিকতা করেছে। তাকে প্রচণ্ড ভয় পাইয়ে মজা দেখেছে। এর বেশি কিছু না। মীরার এই স্বভাব আছে। ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় সে স্কুল থেকে টেলিফোন করে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মা খুব খারাপ খবর আছে। আমাকে প্রমেশিন দেয়নি।
তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, সেকি!
তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম, আমার অঙ্ক আর ইংরেজি পরীক্ষা ভালো হয়নি। এখন দেখলাম দুটাতেই ফেল মার্ক।
তুই কী বলছিস!
হেডমিসট্রেস আপা তোমাকে আসতে বলেছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। মা তুমি আপাকে রিকোয়েস্ট করে আমাকে নাইনে তোলার ব্যবস্থা কর। একই ক্লাসে দুবছর থাকলে আমি মরে যাব।
তুই কি সত্যি ফেল করেছিস?
হ্যাঁ সত্যি।
মনোয়ারা শুনলেন মীরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি বললেন, তুই কাদিস না। আমি এক্ষুনি আসছি।
তিনি স্কুলে গিয়ে শুনলেন মীরা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। ক্লাসের মেয়েরা সবাই ধরেছে চাইনিজ খাবার জন্যে। মীরা এইজন্যেই মাকে খবর দিয়ে এনেছে।
কাল রাতে যে ঘটনার কথা বলল, তার কাছে মনে হচ্ছে, এটা ও মীরার বানানো। অবশ্যই বানানো। তিনি শুধু শুধুই এমন দুশ্চিন্তা করছেন।
মনোয়ারা ফজরের নামাজ পড়লেন। তাঁর মন অনেকখানি শান্ত হল। তিনি আবারো এসে বারান্দায় বসলেন, তখন মনে হল মীরা যা বলছে সবই সত্যি। তার কথার একর্ণও বানানো না। এই মহাবিপদে তিনি কী করবেন?
মীরার বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তার পৱামর্শ চাইবেন? এটা সম্ভব না। ঘটনা শুনে মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করে মীরা যাবে। তার হার্টের অসুখ আছে। এসকিমা না কী যেন বলে। ডাক্তার সিগারেট খেতে মানা করে দিয়েছে। ফ্যাটি খাবার মানা করেছে। এমন একজন অসুস্থ মানুষকে এতবড় কথা বলা যায় না। যে মেয়েকে নিয়ে তাঁর এত অহংকার সেই অহংকার নষ্ট তিনি করতে পারেন না। ব্যাপারটা তাকেই সামাল দিতে হবে। কীভাবে সামাল দেবেন?
একটাই পথ। ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। বিয়ে হলে সব ঝামেলা শেষ। মীরার বাবা হুট করে মেয়ের বিয়েতে রাজি হবে না। তাছাড়া ক্লাসফ্রেন্ডের সঙ্গে বিয়ে। ছেলে চাকরি-টাকরি কিছু করে না, ছাত্র। গ্রাম থেকে এসেছে, পারিবারিক অবস্থাও নিশ্চয়ই খারাপ। এটা মনোয়ারা সামাল দিতে পারবেন। তার সেই ক্ষমতা আছে। যেভাবেই হোক সামাল দেবেন। কোনো একটা কৌশল করে করতে হবে। অবশ্যি কৌশলের দরকারও নেই। তিনি যদি কোনো রাতে ঘুমুতে যাবার সময় কাঁদো-কাঁদো গলায় বলেন তুমি কি আমার একটা কথা রাখবে? মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে বলবে, অবশ্যই রাখব। তোমার কোনো কথাটা আমি রাখিনি?
তখন চোখে পানি এনে বলতে হবে, কথাটা কিন্তু অন্যায়। তোমার উপর জোর খাটানো হবে।
মানুষটা তখন বলবে, কী যন্ত্রণা! কাঁদতে শুরু করলে কেন? কী চাও বল। যা বলবে তাই হবে।
মীরা বলছে ছেলেটা রাজি না। এটা কোনো ব্যাপার না। ছেলে ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন। তাকে বুঝাবেন। দরকার হলে ছেলের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলবেন। প্রয়োজনে তাদের পায়ে ধরবেন। তাকে তার পারিবারের সম্মান রক্ষা করতে হবে। তার মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে হবে।
মনোয়ারা চেয়ার থেকে উঠে রান্নাঘরে গেলেন। দুকাপ চা বানালেন। মীরার বাবাকে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আজই রাজি করিয়ে ফেলতে হবে, দেরি করা যাবে না।
আজহার সাহেব ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। খুবই খুশি হলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, রাতে একফোঁটা ঘুমাওনি তাই না? চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী করেছ সারারাত? মেয়ের সঙ্গে গুটুর-গুটুর