আমার স্বাধীন সত্তা নেই?
না নেই। এই যে আমি বললাম, তুমি আমার সঙ্গে যুমাও—ওমনি তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে এলে যদিও তোমার মন পড়ে আছে বাবার কাছে। দুজনে শুয়ে থাকতে, বাবা বস্ত্রাপচা কোনো বোরিং গল্প শুরু করত। তুমি রোমাঞ্চিত এবং শিহরিত হবার ভান করতে। তুমি হঠাৎ করে মরে গেলে বাবার কী হবে তাই ভাবছি।
মনোয়ারা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, মানুষটা অচল হয়ে পড়বে।
মীরা বলল, মোটেই অচল হবে না। পুরুষমানুষ কখনো অচল হয় না।
মেয়ের কঠিন কঠিন কথা শুনতে মনোয়ারার ভালো লাগছে না। অনেক দিন পর তিনি বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। কোথায় গভীর রাত পর্যন্ত দুজনে মিলে মজা করে গল্প করবেন, তা না মেয়ে কঠিন কঠিন সব কথা বলা শুরু করেছে। মনোয়ারার ইচ্ছা করছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে থাকতে সাহসে কুলুচ্ছি না। মেয়ে হয়তো রেগে যাবে। বড় হলে মেয়েরা খুব আশ্চর্যরকম। ভাবেই বদলে যায়। মীরা যখন ছোট ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে না থাকলে ঘুমুতে পারত না। শুধু যে জড়িয়ে ধরা তা না, তার হাতের মুঠিতে মনোয়ারার শাড়ির আঁচল ধরা থাকত। রাতে বাথরুমে যাওয়া ও সমস্যা। মেয়ের হাত থেকে। শাড়ির আঁচল খুলতে গেলেই মেয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত।
মনোয়ারা নিজের মনে ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, খুব শীত লাগছে। শরীর গরম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে লেপের ভেতর কেউ বরফগলা পানি ঢেলে দিয়েছে।
মীরা বলল, এক কাজ কর মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো।
মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কাছে আসতেই আমার ভয় লাগে না। তুই আমার শরীরে গোবরের গন্ধ, ঘাসের গন্ধ এইসব নাকি পাস।
মীরা হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে রাগাবার জন্যে বলি মা। তোমার গায়ে খুব সুন্দর গন্ধ। সুন্দর না টাটকা গন্ধ।
টাটকা গন্ধ আবার কী?
নতুন বই খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমন গন্ধ।
তোর অদ্ভুত কথাবার্তার আমি কিছুই বুঝি না। আমার গায়ে বইএর গন্ধ। আসবে কেন? বই এর সঙ্গে কি আমার কোনো সম্পর্ক আছে? তোর বাবার গা। থেকে বইএর গন্ধ এলেও একটা কথা ছিল। সে দিনরাত বই নিয়ে থাকে। তোর এখানে আসার সময় দেখেছি এত মোটা এক বই নিয়ে বসেছে। আমি বললাম, শুয়ে পড়। রাত হয়েছে। সে বলছে দুটা পাতা পড়েই শুয়ে পড়বে। আমার ধারণা এখনো বই পড়ছে।
মা যাও দেখে আস বাবা এখনো বই পড়ছে কি-না। যদি দেখ এখনো পড়ছে তাহলে হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেবে। এবং চেক করবে পায়ে মোজা পরেছে কি-না।
মীরা কথাগুলি বলল ঠাট্টা করে কিন্তু মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে গেলেন। মীরা উঠে বসল। সে অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছে। মনোয়ারা মেয়ের দিকে ফিরলেন না বলে মেয়ের অবাক দৃষ্টি দেখলেন না।
আজহার সাহেব সত্যি সত্যি বই পড়ছেন। স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন না। তিনি জানতেন মনোয়ারা আরেকবার খোঁজ নিতে আসবেন। ঘরের দরজা খুলে রেখেছেন এইজনেই। মনোয়ারা হতি থেকে বই নিয়ে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, রাত একটা বাজে। এই বয়সে অনিয়ম করা একদম ঠিক না। দরজা লাগাও, দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়।
তোমরা অনিয়ম করতে পারবে আর আমি পারব না?
আমরা কী অনিয়ম করছি?
এই যে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে যাচ্ছ। সারা রাত গল্প করবে। করবে না?
না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, গিয়েই শুয়ে পড়ব।
আমার উপর মীরার যে রাগ ছিল, সেটা কি একটু কমেছে?
তোমার উপর রাগ থাকবে কেন?
মীরার হাত থেকে বই নিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম।
কী যে তুমি বল। এইসব কি সে মনে করে রেখেছে? মেয়েটা তোমাকে কী যে পছন্দ করে যদি জানতে তাহলে আজেবাজে প্রশ্ন করতে না।
খুব পছন্দ করে?
মুখে বলে না কিন্তু…
কে বেশি পছন্দ করে—মীরা না শেফা?
দুজনই তোমার জন্যে পাগল, তবে আমার ধারণা তোমার দিকে মীরার টানটাই বেশি। আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মীরাই আমাকে পাঠাল দেখে আসার জন্যে তুমি এখনো বই পড়ছ কি-না। আমাকে বলল, তুমি অবশ্যই বাবার হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে বাবাকে শুইয়ে দেবে। বাবা মোজা পরেছে কি-না দেখবে। ভালো কথা, তুমি মোজা পরেছ?
হুঁ।
এসো দরজা বন্ধ কর। আমি চলে যাব।
আজহার সাহেব বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, সারাক্ষণ বকাবকি করি, তারপরেও মেয়ে দুটা আমাকে এত পছন্দ করে কেন এই রহস্যটাই বুঝলাম না।
আনন্দে আজহার সাহেবের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। পৃথিবীর দশজন সুখী মানুষের তালিকা করা হলে তার নাম সেই তালিকায় থাকবে। উপরের দিকেই থাকবে।
মনোয়ারা মেয়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কিরে তুই বসে আছিস কেন?
মীরা হাসিমুখে বলল, তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে বসে আছি।
আমার তো ঘুম আসছে।
ঘম এলে ঘুমিয়ে পড়। সারাদিন পরিশ্রম করেছ। ছোটাছুটি-রান্নাবান্না।
মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে হালকা গলায় বললেন, সাবের ছেলেটার সঙ্গে তোর কি ঝগড়া টগড়া হয়েছে?
না। আমার সঙ্গে কারোর ঝগ হয় না।
মাঝে মাঝে ঝগড়া হওয়া ভালো। ঝগড়া হচ্ছে ঝড়ের মতো–ঝড়ে যেমন ধুলা ময়লা উড়ে যায়, ঝগড়াতেও মনের ধুলা ময়লা উড়ে যায়।
মা প্লিজ জ্ঞানের কথা বলবে না। বাবার সঙ্গে থেকে তোমারও দেখি জ্ঞানের কথা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।