কী বললেন, স্যার, খেয়ে ফেলে?
হ্যাঁ খেয়ে ফেলে। তারা বিশ্বাস করে এতে মৃত আত্মার সদগতি হয়।
আমরা তো স্যার সেই তুলনায় ভালো আছি।
হ্যাঁ আমরা ভালোই আছি। আমাদের জন্য ভjত তো অতি প্রাচীন। তার পরেও সতীদাহের মতো কুৎসিত প্রথা ছিল। হিল না? ওরা যা করছে মত মানুষদের নিয়ে করছে আর আমরা জাস্তি মানুষ পুড়িয়ে মেরে ফেলছি।
এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেব মুগ্ধ গলায় বললেন, স্যার আপনি এত বিষয় জানেন, এত সুন্দর করে গল্প করেন এটা একটা অবিশ্বাস্য বিষয়। আপনার গল্প শোনা ভাগ্যের ব্যাপার। সন্ধ্যার পর আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। স্যার হয়তো খুবই বিরক্ত হন।
বিরক্ত হব কেন?
স্যার বিরক্ত হন আর নাই হন আমরা না–এসে পারব না।
অবশ্যই আসবেন। ভালো কথা, আগামীকাল রাতে আপনারা আমার সাথে চারটে ডালভাত খাবেন।
ছিঃ ছিঃ স্যার কী বলেন! আপনি আমাদের মেহমান। কোথায় আমরা খাওয়াব তা না।
কী আশ্চর্য, আমি এই গ্রামের ছেলে না? আপনারা চারটা ডাল ভাত। অবশ্যই খাবেন।
শেফা এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। আড়াল থেকে এদের কথাবার্তা শুনতে তার খুব মজা লাগছে। তার বাবার মহাবিরক্তকর গল্পগুলি ও যে লোকজন এত আগ্রহ করে শুনতে চায় এটা শেফার ধারণার ও বাইরে ছিল। গ্রামের এই মানুষগুলো কি বোকা নাকি?
আসলে এক ভদ্রলোক আজ দেরি করে এসেছেন। তিনি কবিরাজ নাশী কালো। তাঁর নেত্রকোনায় দোকান আছে। দোকান এখন ছেলে দেখাশোনা করে। তিনি বাড়িতে থাকেন। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি ঢুকলেন এবং হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাগী-রাগী গলায় বললেন, হেডমাস্টার সাহেব কাজটা আপনি কী করলেন? আমাকে না নিয়ে চলে আসলেন। আমি কাল বলেছিলাম না, আসার সময় আমাকে নিয়ে আসবেন। আমি সন্ধ্যা থেকে কাপড় পরে বসা।ITeam
হেডমাস্টার সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, একদম ভুলে গেছি।
তাতো ভুলে যাবেনই। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে উল্টা আমি আপনার খোঁজে গিয়ে শুনি আপনি সন্ধ্যার সময় চলে গেছেন।
আসছি বেশিক্ষণ হয়নি, এইতো কিছুক্ষণ আমার কথা বিশ্বাস না হয় স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।
আজহার সাহেব হাস্যমুখে দুই বন্ধুর ঝগড়া সামাল দেন। তাকে আবারো পাপ ভক্ষকদের গল্প নতুন করে শুরু করতে হয়। যারা গল্পটা আগে শুনেছেন তারাও সমান আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয়বার গল্পটি শুনেন। হেডমাস্টার সাহেব আগেরবার গল্পের ঠিক যে-জায়গায় বলেছিলেন শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়?—এবারে ঠিক সেই জায়গায় আঁৎকে উঠে জিজ্ঞেস করেন, স্যার শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়? তখনো কি এই অবস্থা। যেন তিনিও এই প্রথমবারের মতো গল্পটা শুনছেন।
শেফা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবার গল্প শুনতে তার ভালো লাগছে। এখন তার ধারণা হয়েছে যে তারা আগ্রহ নিয়ে। বাবার গল্প শোনে না বলেই বাবার গল্পগুলি তত ভালো হয় না। এরা আগ্রহ নিয়ে শুনছে বলে ভালো হচ্ছে।
আজহার সাহেব হঠাৎ গল্প থামিয়ে বললেন, দরজার পাশে কে?
শেফা বলল, বাবা আমি।
কী করছ মা?
বাবা তোমার গল্প শুনছি।
হেডমাস্টার সাহেব অত্যন্ত সাধু ভাষায় বললেন, মা এইসব গল্প তোমার শোনার উপযুক্ত নয়। গল্পগুলি পরিণত মানসিকতার মানুষদের জন্যে। মা তুমি চলে যাও। যদি সম্ভব হয় চাচাদের জন্যে একটু চা পাঠাও।
আজহার সাহেব বললেন, কফি খাবেন না-কি?
কফির ব্যবস্থা আছে?
জ্বি আছে।
তাহলে স্যার একটু বড়লোকি জিনিস খেয়ে দেখি।
শেফা কফির কথা বলতে চলে গেল। এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেব বললেন, স্যারের দুটা মেয়েই অত্যন্ত ভালো। ভালো হবে জানা কথা। যেমন গাছ তেমন তার ফল।
আজহার সাহেব বললেন, সামান্য ভুল করলেন মাস্টার সাহেব। খুব ভালো গাছের ফল হয় না। যেমন ধরুন সেগুন গাছ, শাল গাছ।
উপস্থিত শ্রোতারা আজহার সাহেবের জ্ঞানের কথায় আবারো অত্যন্ত চমৎকৃত হন। আজহার সাহেব পাপ-ভক্ষকদের গল্পের শেষাংশ শুরু করলেন–শ্রোতারা তার দিকে ঝুঁকে এল।
মনোয়ারা বড় মেয়ের সঙ্গে
মনোয়ারা বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। আজ রাতে মনে হয় জমিয়ে শীত পড়েছে। লেপের নিচেও শরীর গরম হচ্ছে না। মীরার শীত সহ্য হয় না। সে লাল টুকটুকে কার্যে মাথা কান ঢেকে শুয়েছে। ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। বারান্দায় একশ ওয়াটের বাতি জ্বলছে। যদিও তেমন আলো হচ্ছে না। ঘরের ভেতরে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে না। ঘরে হারিকেনের আলো। মীরার কাছে না-কি হারিকেনের আলো অনেক আপন লাগে।
মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আজ মাঘ মাসের কত তারিখ বলতে পারবি?
মীরা বলল, পারব, ন তারিখ।
মাঘ মাসের অমাবস্যায় সবচে শীত পড়ে। আজ কি অমাবস্যা?
অমাবস্যা না মা, কাল রাতেই না তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুকিদের মতো চেঁচিয়ে বললে, ওমা কী সুন্দর চাদ! বাবাকে খুশি করার জন্যে বললে। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে গেল, কারণ তার গ্রামের চাদ সুন্দর।
মনোয়ারা বিরক্ত গলায় বললেন, তোর ধারণা আমি যা করি সব তোর বাবাকে খুশি করার জন্যে?
হ্যাঁ আমার তাই ধারণী। আগের জন্মে তুমি কী ছিল জানো মা? আগের জন্মে তুমি ছিলে কোনো মহারাজার প্রধান চাটুকার। ইয়েস ম্যান। এই জন্যেও সেই স্বভাব রয়ে গেছে।
চুপ করবি?
না চুপ করব না। তোমার উপর আমার খুব রাগ লাগে মা। তোমার। কোনো স্বাধীন সত্তা কেন থাকবে না।